উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার ও মাদ্রাসা শিক্ষা
বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশে ৫০০ মিলিয়ন মুসলমানের বসবাস। সারা বিশ্বের মুসলিম জনসংখ্যার সিংহভাগ এই অঞ্ছলে বাস করে। উপমহাদেশে প্রবেশের পর হতেই ইসলাম এই অঞ্ছলের অধিবাসীদের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে আসছে। বর্তমানে ভারতে ইসলামের আগমন সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন অনেকগুলো তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো ভারতে আরব ও পারসিক মুসলমানদের আগ্রাসনের ফলে ভারতে ইসলাম প্রচারিত হওয়ার কথা বলার চেষ্টা করছে। যদিও, তাদের এই দাবী বাস্তবিক নই।
ইতিহাস বেত্তারা বলেন, ইসলামের আবির্ভাবের বহু পূর্ব থেকেই আরব বণিকগণ বাণিজ্যের জন্য ভারত উপমহাদেশে আগমন করে। এ উপমহাদেশে ইসলামের আগমন ঘটেছে মূলত তিন ভাবে ক) ইসলাম প্রচারক বুজুর্গ, সূফী-সাধকদের মাধ্যমে খ) আরব বণিকদের মাধ্যমে, গ) মুসলিম শাসকদের মাধ্যমে।
আরব বণিকরা মালাবার হয়ে চীনের পথে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করতেন। এ উপমহাদেশের আদি নাম সিন্দ ও হিন্দ আরবদেরই দেয়া নাম। জানা যায় আরবের সাবা কওমের নামানুসারে নামকরণকৃত শহর সাবাউর (উর অর্থ শহর) আজও ঢাকার অদূরে সাভার নামে পরিচিত। এছাড়া বাররুন হিন্দ (ইন্ডিয়ান ভূখন্ড) বরেন্দ্র ভূমির কথা তো সর্বজনবিদিত।
প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই আরবরা ছিল ব্যবসাপ্রিয় জাতি। পবিত্র কোরআনেও তাদের এ বাণিজ্যপ্রীতির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। (আল কোরআন, সুরা আল কুরাইশ, আয়াত : ১-২) ঐতিহাসিক এলফিনস্টোন বলেন, হজরত ইউসুফ (আ.)-এর আমল থেকেই ভারতের সঙ্গে আরবদের চমৎকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। (নাসির হেলাল, যশোর জেলায় ইসলাম প্রচার ও প্রসার, যশোর : সীমান্ত প্রকাশনী, ১৯৯২, পৃ.-৩৭) আরবে ইসলামের আগমনের পূর্বে রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে পারস্যের সাসানীয় সাম্রাজ্যের অব্যাহত যুদ্ধ-সংগ্রামের কারণে আরবদের স্থলভাগের বাণিজ্যপথে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটলে জাত ব্যবসায়ী আরবরা প্রয়োজনের তাগিদে বাধ্য হয়ে সমুদ্রবাণিজ্যে আগ্রহী হয় ও নৌপথ অনুসন্ধান করে। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দী থেকেই আরবরা নৌবাণিজ্যে ইয়েমেন, হাযরামাউত, দক্ষিণ ভারতের মালাবার, কালিকট, চেরর, বার্মা, কম্বোডিয়া অঞ্চলে বাণিজ্যের জন্য যাতায়াত করত। (মুহিউদ্দিন খান, ‘বাংলাদেশে ইসলাম : কয়েকটি তথ্যসূত্র’, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, (ঢাকা : ই.ফা.বা. এপ্রিল-জুন, ১৯৮৮), পৃ. ৩৪৬) তখন থেকেই আরবরা নাবিক হিসেবে সমুদ্র অভিযানে পারদর্শী ছিল। আরব দেশ থেকে বছরে অন্তত দু’বার আরব নৌবহর মৌসুমি বায়ু ধরে বাণিজ্যিক পণ্য আদান-প্রদানের জন্য ভারত মহাসাগর অঞ্চলে যাতায়াত করত। (মো. আতাউর রহমান বিশ্বাস, ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ইসলাম, প্রবন্ধাবলী, (ঢাকা : উচ্চতর সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, ঢাবি, জুন, ১৯৯৯, পৃ.-২১৭) শুধু তা-ই নয়, ভারতের বিশিষ্ট ইসলামী গবেষক সাইয়্যিদ সুলায়মান নদভী (র.) তার বিরল গবেষণা গ্রন্থ ‘আরব ও হিনদ কি তাআল্লুকাত’-এ লিখেছেন, মিসর থেকে সুদূর চীন পর্যন্ত প্রলম্বিত দীর্ঘ নৌপথে আরবগণ যাতায়াত করতেন। (শাহ ওয়ালী উল্লাহ, হুজ্জাতিল্লাহিল বালিগাহ-এর মুকাদ্দমা, (দিল্লি : আসাহহুল মাতাবি, ২০০০ইং)
প্রাচীনকাল হতে ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের স্থল ও জল উভয় পথেই যোগাযোগ বিদ্যমান ছিল। আর এটা ছিল বাণিজ্যিক সম্পর্ক। এরূপ অর্থনৈতিক বিনিময় উভয়ের সাংস্কৃতিক বিনিময়কে গতিশীল ও দৃঢ় করেছে। তবে প্রাক-ইসলামী যুগে ধর্মীয় আচারে পৌত্তলিকতার ব্যাপক অনুসরণ উভয় সংস্কৃতিকে গতিধারায় নতুন মাত্রা সংযোজন করে। আরবদের ধর্মীয় আচারে পৌত্তলিকতার প্রভাব কি ভারতীয় সংস্কৃতির অবদান? সপ্তম শতকে আরব ভূমিতে ইসলামের আবির্ভাবে আরব জীবনের গতিকে বেগবান করে তোলে। যার প্রভাব তাদের বৈষয়িক কর্মকাণ্ডে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। ফলে খলিফা ওমরের সময়েই জল ও স্থল উভয় পথে ভারতের উদ্দেশে রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা শুরু হয়। আর অষ্টম শতকে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয় ছিল সে উদ্যোগেরই ফল। (তারা চাঁদ, অনুবাদ : করুণাময় গোস্বামী, ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৮৮, পৃ. ২৬) যদিও এর রাজনৈতিক প্রভাব ফলপ্রসূ ছিল না, কিন্তু সাংস্কৃতিক প্রভাব ছিল কালোত্তীর্ণ।
সাংস্কৃতিক সম্পর্কের মধ্যে সুলতান মাহমুদের বার বার ভারত আক্রমণ ভাঙনের সুর সৃষ্টি করে। কিন্তু বৈষয়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে দেখা যায় সুলতান মাহমুদ ভারতে মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠার অন্যতম অগ্রদূত। যা মুহাম্মদ ঘুরীর ও বখতিয়ার খলজীর রাজনৈতিক তৎপরতায় চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। তাই আরবদের ভাগ্যকে স্বীকার করে নিয়ে বলতে হয় ভরতবর্ষে রাজনৈতিকভাবে মুসলিম আধিপত্য বিস্তারের কৃতিত্ব তুর্কীদের, আরবদের নয়।
মালাবার উপকূল বয়ে তারা চীনের পথে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করতেন। (মুহিউদ্দীন খান, প্রাক্তন, পৃ.-৩৪১) এবং তৎকালীন বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দরগুলোতে এসে চন্দন কাঠ, হাতির দাঁত ও দন্ত নির্মিত বিভিন্ন আসবাবপত্র, মসলা, মূর্তি, কাপড় ইত্যাদি ক্রয় এবং জাহাজ বোঝাই করে নিজেদের দেশে নিয়ে যেতেন। (এম. নাজির আহমদ, ‘বাংলাদেশে ইসলামের আগমন’, মাসিক পৃথিবী, ঢাকা : জানুয়ারি, ১৯৯৭, পৃ ৩০) এ সম্পর্কে খালিক আহমেদ নিযামী বলেন :
India’s relation with the Arab world go back to hoary past long before the rise of Islam, there was brisk commercial contact between India and Arabia and the Arab traders carried Indian goods to the European markets by way of Egypt and Szria. Elphinstone has rightly observed that from the days of Joseph to the days of Marco Polo and Vasco de Gama the Arabs were the captains of Indian commerce. There were large number of Arab colonies on the western coast of India and many India settlements in the Arab countries. Ubull, for instance, was known as Ard-ul-Hind on account of the large number of Indians who inhibited that region. When Islam spread and the Arabs got converted to Islam, these colonies continued to flourish as before. The Indian rajas appointed Muslim judges, known as hunurman, to decide their cases and provided all facilities to them to organize their community life. Commercial contact led to cultural relations and while large number of Arab navigational and other terms were adopted by the Indians. Indian customs, institutions and practices found their way to Arabia, Philologists have traced three Sanskrit words misk (Musk), Zanjabil (Ginger) and kafur (Camphor) in the Quran. (কে. এ. নিযামী : ড. মুহাম্মদ যাকী সম্পাদিত Arab acconts of India গ্রন্থের ভূমিকা।)
উপমহাদেশের সরবতক নামক জনৈক শাসক রসুল (সা.)-এর নিকট ভারত বর্ষের এক পাত্র ‘যানযাবিল’ বা আদ্রকসহ বেশকিছু উপহার-উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন বলে হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। হাদিসটির অনুবাদ এরূপ :
According to a narration by abu Sayed khudri (R.) Sarbatak king of kunj (India) sent an earthen ware full of gingers to prophet Muhammad (Sm.) as presents. It is also reported that Hazrat Muhammad (Sm.) sent Hudhayfa, Usama and Suhayb to the king inviting him to accept Islam. Sarbatak embraced Islam. He also said, “I saw the prophet’s face. First in Macca, then in Madina, He was middle statured and very handsome.(অধ্যাপক আবদুল গফুর, ‘মহানবীর যুগে উপমহাদেশ’, অগ্রপথিক, সীরাতুন্নবী (সা.) সংখ্যা, (ঢাকা : ই.ফা.বা. ২৭ অক্টোবর, ১৯৮৮, পৃ-৫৩।)
নির্ভরযোগ্য ইতিহাস থেকে প্রমাণিত হয় যে, ইসলামী বিপ্লবের প্রথম কয়েক বছরে নবুয়ত ও প্রথম খলিফার আমলে না হলেও দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর খিলাফতকালে বিশ্বনবীর পাঁচজন মহাত্মা সাহাবিও উপমহাদেশে আগমন করেছেন। (মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, হাদিস সঙ্কলনের ইতিহাস, পৃ.-৪৫৭) ২৩-৪০ হিজরির মধ্যেই পাক-ভারতের পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত ওই মুসলিম প্রচারক ও মুজাহিদ বাহিনী পৌঁছেছিলেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। (মাওলানা নূর মোহাম্মদ আ’জমী, হাদিসের তত্ত্ব ও ইতিহাস, ঢাকা : এমদাদীয়া লাইব্রেরী, ১৯৯২, ৪র্থ সংস্করণ, পৃ.-১৩৫) এ সময় যে পাঁচজন সাহাবির ভারত আগমনের সন্ধান পাওয়া যায় তারা হলেন : (১) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ইতবান (রা.), (২) হজরত আসেম ইবনে আমর আততামীমী (রা.), (৩) হজরত সুহার ইবনে আল-আবদী (রা.), (৪) হজরত সুহাইল ইবনে আদী (রা.), (৫) হজরত হাকাম ইবনে আবিল আস আছ ছাকাফী (রা.)। (ডক্টর মোহাম্মদ এছহাক, ইলমে হাদিসের ভারতীয় উপমহাদেশের অবদান, অনুবাদ-হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ জাকারিয়া, ঢাকা : ই.ফা.বা. ১৯৯৩, ১ম সংস্করণ, পৃ.-৮)
যদি প্রকৃতই সহিংসতা ও যুদ্ধের মাধ্যমেই ইসলামের বিস্তার ঘটতো, তবে ভারতে মুসলিম শাসনের কেন্দ্রসমূহেই আজকে বরং মুসলমানের সংখ্যা অধিক হত। এর বদলে আমরা দেখি, ভারতীয় উপমহাদেশের একবারে দূরবর্তী দুই প্রান্তে বরং মুসলমানের সংখ্যা বেশী। এছাড়া ভারতের মধ্যকার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভূমিগুলো হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জনবসতি দ্বারা বিচ্ছিন্ন। এটিই ভারতে শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রচারের প্রমাণ। মুসলমানরা যদি অসহিষ্ণু হত, তবে চারপাশের এই অমুসলিম জনবসতির অস্তিত্বের প্রশ্নই আসতোনা।
ভারতবর্ষে ইসলামের গোড়াপত্তন
রাসূল (সা.) এর জন্মের পূর্ব হতেই ভারতের সাথে আরব বণিকদের যোগাযোগ ছিলো। বাণিজ্যের উদ্দেশে আরবদের ভারতের সাথে নিয়মিতই যোগাযোগ হত। স্বাভাবিকভাবেই, আরবরা যখন ইসলাম গ্রহণ করে, বাণিজ্যের পাশাপাশি তারা তখন তাদের নতুন বিশ্বাসের বাণী নিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতই ভারতে আগমন করে। রাসূল সা.-এর জীবদ্দশায় তার চাচত মামা হযরত আবুয ওক্কাস উহাইদ বিন মালেকসহ ৪ জন সাহাবা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও মিয়ানমারের আরাকান এলাকায় ইসলাম প্রচারের জন্য এসেছিলেন। তারা এখান থেকে চীন পর্যন্ত ইসলাম প্রচার করেছিলেন। চীনের ক্যান্টন সমুদ্রতীরে অবস্থিত সাহাবী আবু ওয়াক্কাস মালিক বিন ওহাইবের মসজিদ ও কবর সে সাক্ষ্যই দেয়। ৬২৯ খ্রি. মালিক বিন দিনার (রা) চেরামান জুমা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। মাপিলার জাতি-গোষ্ঠিই সম্ভবত ভারতের প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী সম্প্রদায়। তখন থেকেই দায়ীদের দাওয়াতের মাধ্যমে প্রচুর স্থানীয় মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন। প্রথম ভারতীয় মুসলমান চেরামান পেরুমল ভাস্কর রবী ভার্মা এই মসজিদটি নির্মান করেন। আরব মুসলমান ও ভারতীয়দের মধ্যে বাণিজ্যের প্রেক্ষিতে ভারতীয় সমুদ্র তীরবর্তী জনবসতিসমূহে ইসলামের প্রসার ঘটতে থাকে। আরব মুসলমান বণিকদের আগমন এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের ইসলাম গ্রহণের মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
যতদূর জানা যায়, ভারত থেকে কতেক লোক মদীনায় গিয়ে রাসূল সা. এর সংস্পর্শ লাভেও ধন্য হন। তাদের মধ্যে যাদের নাম জানা যায়, বাবা রতন আল-হিন্দ অথবা রতন আবদুল্লাহ আল-হিন্দ মদিনায় গিয়ে রাসূল সা. এর কাছে ইসলাম গ্রহণ করে সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন বলে জানা যায়। শুধু তাই নয়, মালাবারের অনুগত চেরদেশের রাজা চেরম রাসূল সা. এর কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বলেও জানা যায়। পরবর্তীতে বহু সূফী-দরবেশ ভারতবর্ষে আগমন করেন এবং ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রচার করতে থাকেন।
হযরত উমর রা. কর্তৃক পারস্য বিজয়ের পর উপমহাদেশীয় অঞ্চলসমূহকে খিলাফতভক্ত করার প্রতি মুসলমানদের দৃষ্টি প্রসারিত হয়। হযরত উমর রা. কর্তৃক নিযুক্ত বাহরাইন ও ওমানের শাসনকর্তা প্রখ্যাত সাহাবী হযরত উসমান বিন আবদুল আস-সাকাফী (রা.) ভ্রাতা আল-হাকামকে সিন্ধুর বরুচ অঞ্চলে এবং অপর ভ্রাতা মুগীরা বিন আবুল আসকে দেবল অভিযানে প্রেরণ করলে তারা তথাস্থ ক্ষমতাসীনকে পরাজিত করে ভারতের সীমানায় প্রথম ইসলামের বিজয় কেতন উড্ডীন করেন। এসময়ে আগত সাহাবীদের মাঝে যাদের নাম জানা যায় তারা হলেন-আবদুল্লাহ বিন আবদুল্লাহ ওতবান, আশ-ইয়াম বিন আমর তামীমী, সোহার বিন আল আবদী, সুহাইল বিন আদি প্রমূখ।হযরত উসমান রা. এর শাসনামলেও ভারতবর্ষে সিন্ধুনদসহ সিন্ধু অঞ্চলের বহু এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ইসলামের ছায়াতলে আনতে সক্ষম হন।
হযরত আলী রা. এর খিলাফতকালে সিন্ধুর উত্তর পশ্চিমাঞ্চল মুসলিম সাম্রাজ্যভ‚ক্ত হয়েছিলো। হযরত মুআবিয়া রা. এর যুগে প্রথমে আবদুল্লাহ বিন সাওয়ার আবদীর নেতৃত্বে অতঃপর সিনান বিন সালমাহ হুযাইলীর নেতৃত্বে ভারত সীমান্তে আক্রমণ চালানো হয়। ৪৪ হিজরীতে প্রখ্যাত তাবেয়ী মুহাম্মদ বিন আবু সুফরাহ ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে পাঞ্জাবের লাহোর ও বান্না এলাকা পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু মুআবিয়া রা. এর পরবর্তীকালে মুসলমানদের ঘরোয়া সমস্যার কারণে তারা ভারতবর্ষের প্রতি মনযোগ দিতে পারেননি।উমাইয়া খলিফা প্রথম ওয়ালীদের শাসনামলে পূর্বাঞ্চলীয় এদেশসমূহের গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসূফ ভারতবর্ষের মোট তিনটি অভিযান প্রেরণ করেন। পরপর দুটি অভিযান উবায়দুল্লাহ বুদাইলের নেতৃত্বে ব্যর্থ হলে সপ্তদশবর্ষীয় তরুন সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিরমের নেতৃত্বে ভারত অভিমূখে প্রেরণ করেন।
হিন্দু শাসকদের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ ও বিক্ষুব্ধ হয়ে জাঠ ও মেঠ সম্প্রদায় মুহাম্মদ বিন কাসিমের সহযোগীতায় এগিয়ে আসেন। এমনকি মারকানের অধিপতি একদল সৈন্য দিয়ে বিন কাসিমকে সহযোগীতা করেন। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে রাজা দাহিরকে পরাজিত করে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলমানদের দৃঢ় ঈমান, উন্নত চরিত্র নৈতিকতা,সুষ্ঠু পরিচালনা ও দক্ষতা দেখে হিন্দু শাসক কর্তৃক নির্যাতিত নিপীড়িত জনতা দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে।
মুহাম্মদ বিন কাসিম রাজধানী দামেস্কে ফিরে গেলে খলীফা সুলায়মান ইয়াযিদ বিন মুহাল্লাবকে সিন্ধু দেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তার মৃত্যুর পর তার ভাই হাবীব শাসন ক্ষমতায় আসেন। তারপর ৭২৪ খ্রি. শাসক জুনায়েদ হাবীবের স্থলে শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। ৭৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি ভারতের অনেক এলাকা জয় করেন এবং বিপুল জনসমর্থন লাভ করেন। সুলতান মাহমুদ গজনভী ১০০০ খ্রি. থেকে ১০২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতবর্ষে মোট ১৭ বার অভিযান পরিচালনা করে প্রত্রেক বারই বিজয় অর্জন করেন। মি. কেনী তার সম্পর্কে বলেন, মাহমুদ যেমন বিরাট রাজ্য জয় করেছেন তেমনি বিজ্ঞাতার সঙ্গে সুশাসন করতেও সক্ষম হয়েছেন।
সুলতান মুহাম্মদ ঘুরী ১১৭৩ খ্রি. গজনী অধিকার করে ভারত অভিযানে মনোনিবেশ করেন। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে তিনি দিল্লি, আজমীর, সিন্ধু, কনৌজ, গুজরাট, বিহার ও বাংলা অধিকার করেন। ভারত উপমহাদেশের প্রথম সুলতান হিসাবে মুহাম্মদ ঘুরীকে আখ্যায়িত করা হয়। তার মৃত্যুর পর তার আজাদ করা গোলাম কুতুব উদ্দিন আইবেক ১২০৬ খ্রি. দিল্লির শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তার প্রতিষ্ঠিত রাজবংশকে মামলুক সালতানাত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় যে বংশ ১২৯০ খ্রি. পর্যন্ত ভারত শাসন করে। এরপর খিলজি সালতানাত, তুঘলক সালতানাত, সাইয়িদ সালতানাত, লোদি সালতানাত এবং সর্বশেষ মুঘল সা¤্রাজ্য ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। প্রায় হাজার বছর মুসলমানগণই এই উপমহাদেশ শাসন করে।মুবাল্লিগ বা ইসলাম প্রচারকদের দ্বারাও ইসলাম ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পরে। ভারতে ইসলাম প্রচারে তাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা মুসলিম শাসকদের দরবার হতে ইসলামকে ভারতের গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে দেন।
উপমহাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত UNESCO-এর Studies on Compulsory Education-এ উল্লেখ করা হয়েছে : ‘মুসলিম শাসনামলে শিক্ষা ও ধর্মকে অত্যন্ত অঙ্গাঙ্গিভাবে বিবেচনা করা হতো।’ সে আমলে মুসলিম পরিবারের শিশুদের হাতেখড়ি হতো পবিত্র কোরআনের শিক্ষার মাধ্যমে। ইতিহাসবিদ এ আর মল্লিক লিখেছেন : ‘বাংলার মুসলমানদের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে যখন কোনো সন্তানের বয়স চার বছর চার মাস চার দিন পূর্ণ হতো, তখন তার বিদ্যাশিক্ষার সূচনা হতো। একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পবিত্র কোরআনের কিছু অংশ শিশুকে পাঠ করে শোনানো হতো। শিশু তা পুনরাবৃত্তি করত। এ ছিল প্রতিটি মুসলিম পরিবারের অপরিহার্য প্রথা।’ (A. R. Mallic, British policy And Muslim in Bengal, p.149)
মাদরাসা শিক্ষা বিস্তারে মুসলিম শাসকদের অবদান প্রসঙ্গে এফ ফজলুর রহমান লিখেছেন : ‘ডাবলিউ এডমের মতে, সে আমলে অতি সুলভে এমনকি বলতে গেলে বিনা পয়সায় শিক্ষা লাভ করা যেত। প্রতিটি মসজিদ ছিল মুসলিম জনগণের কেন্দ্রীয় আকর্ষণস্থল। আর মসজিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল মাদরাসা।’ (The Bengali Muslim And English Education, p. 140)
ভারতে ‘দিল্লি সালতানাত’ স্থায়ী হয় প্রায় ৩২৫ বছর (১২০১-১৫২৮)। কারো কারো মতে, ৩২০ বছর (১২০৬-১৫২৬)। চারজন তুর্কি ও একজন আফগান বংশোদ্ভূত সুলতান এই সময়ে দিল্লি ও এর আশপাশের এলাকা নিয়ে সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। এ সময় ভারতবর্ষে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই উদ্যোগের একটি প্রধান দিক ছিল মসজিদ ও মাদরাসা নির্মাণ। দিল্লিতে প্রথম মাদরাসা স্থাপিত হয় শামসুদ্দিন ইলতুিমসের আমলে (১২১১-১২৩৬)। তাঁর শাসনামলে গোটা দিল্লি নগরী তদানীন্তন ভারতের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গৌরব ও মর্যাদা লাভ করেছিল। দিল্লি সালতানাতের পাঁচটি রাজবংশের মধ্যে তুঘলকদের আমলে মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয় সবচেয়ে বেশি। মুহাম্মদ বিন তুঘলকের ২৫ বছরের শাসনামলে শুধু দিল্লিতেই প্রায় এক হাজার মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। ফিরোজশাহ তুঘলক (১৩৫১-১৩৮৮ খ্রি.) তাঁর রাজত্বকালে শিক্ষা খাতে মোট ১,৩০,০০,০০০ তংকা ব্যয় করেছেন। এ থেকে আলেম ও শিক্ষকরা পেয়েছেন ৩৬,০০,০০০ তংকা। অবশিষ্ট অর্থ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, গ্রন্থ সংগ্রহ, গ্রন্থ প্রকাশনা ইত্যাদি কাজে ব্যয় করা হয়।
বাংলার সুলতানি আমলে মুসলিম সমাজের প্রাথমিক শিক্ষা ছোট ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে মসজিদকেন্দ্রিক পরিচালিত মক্তবে সম্পন্ন হতো। এ কারণে মুসলিম সুলতান ও তাঁদের অধীন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বাংলাজুড়ে যেসব মসজিদ গড়ে উঠেছিল, সেগুলো মুসলিম সমাজের প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারেও অবদান রাখত।
মোগল আমলে মাদরাসার সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যায়। সম্রাট বাবরের আমলের (১৫২৬-১৫৩০) রাজদরবারের কাগজপত্র থেকে জানা যায়, বাবরের প্রশাসন মনে করত, জনগণের শিক্ষা হচ্ছে শাসকের দায়িত্ব। আকবরের আমলে শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত করার জন্য একটি বিশেষ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে (১৬০৫-১৬২৭) একটি বিশেষ আইন জারি ছিল যে যখন কোনো বিদেশি নাগরিক বা কোনো দেশীয় ব্যবসায়ী কোনো উত্তরাধিকারী না রেখে মৃত্যুবরণ করতেন, তখন তাঁর রেখে যাওয়া ভবনগুলো মেরামত করে মাদরাসা কিংবা অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হতো।
উপমহাদেশে মুসলিম যুগের অবসান ঘটে বেনিয়া ইংরেজদের আমলে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়, ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লবের পর পাক-ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ বেনিয়াদের চূড়ান্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৭৬৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সম্পাদিত নবাব মীরজাফর ও রবার্ট ক্লাইভ চুক্তিমূলে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি নবাব মীরজাফরকে আদায়কৃত রাজস্ব থেকে প্রদান করত ৫৩,৮৬,১৩১ টাকা। এ সামান্য টাকার বিনিময়ে বাংলার জনগণের ভাগ্য বিক্রি হয়ে যায় ইংরেজদের হাতে। ইংরেজরা সুবা-বাংলার খাজনা আদায়ের দায়িত্ব পেয়ে লক্ষ করে যে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় ৮০ হাজার মক্তব-মাদরাসা ছিল। এই ৮০ হাজার মক্তব-মাদরাসার জন্য বাংলার চার ভাগের এক ভাগ জমি লাখেরাজভাবে বরাদ্দ ছিল।
ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি ক্রমে এই লাখেরাজ সম্পত্তি আইন, বিধি-বিধান প্রণয়ন এবং জোর-জবরদস্তি করে দেশের হিন্দু জমিদার ও প্রজাদের ইজারা দিতে থাকে। এসংক্রান্ত তিনটি বিধান হলো : (১) ১৭৯৩ সালের রেগুলেশন—১৯, (২) ১৯১৮ সালের রেগুলেশন—২, (৩) রিজামসান ল অব ১৮২৮ (লাখেরাজ ভূমি পুনঃ গ্রহণ আইন)। ফলে মাদরাসার আয় কমতে থাকে। বহু মাদরাসা বন্ধ হয়ে যায়। গুটিকয়েক মাদরাসা কোনোভাবে অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। ১৭৬৫ সালে বাংলায় মাদরাসার সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার। ২০০ বছর পর ১৯৬৫ সালে এ সংখ্যা দুই হাজারের নিচে নেমে আসে। (এ জেড এম শামসুল আলম, মাদরাসা শিক্ষা, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিমিটেড, চট্টগ্রাম-ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ : মে-২০০২, পৃষ্ঠা ৩-৪)
সুলতানি আমলে মাদ্রাসা শিক্ষা
তেরো শতকের প্রারম্ভে ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজির বাংলার একটি সীমান্তবর্তী অঞ্চল নদিয়া জয়ের মাধ্যমে বাংলায় প্রথমবারের মতো মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হয়। পরবর্তী সময়ে প্রায় শত বছরের মধ্যেই সারা বাংলায় মুসলিম শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। ১২৫৩ খ্রিস্টাব্দে সারা বাংলাকে একত্র করে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ স্বাধীন বাংলার মুসলিম রাষ্ট্র গঠন করেন। পরবর্তী সময়ে এটি প্রায় কয়েক শ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে টিকে থাকে। ভারতে ‘দিল্লি সুলতানাত’ স্থায়ী হয় প্রায় ৩২৫ বছর (১২০১-১৫২৮)। কারো কারো মতে, ৩২০ বছর (১২০৬-১৫২৬)। চারজন তুর্কি ও একজন আফগান বংশোদ্ভূত সুলতান এই সময় দিল্লি ও এর আশপাশের এলাকা নিয়ে সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। এ সময় ভারতে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই উদ্যোগের একটি প্রধান দিক ছিল মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ। দিল্লিতে প্রথম মাদ্রাসা স্থাপিত হয় শামসুদ্দিন ইলতুিমশের আমলে (১২১১-১২৩৬)। তাঁর শাসনামলে গোটা দিল্লি নগরী তদানীন্তন ভারতের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গৌরব ও মর্যাদা লাভ করেছিল। দিল্লি সুলতানাতের পাঁচটি রাজবংশের মধ্যে তুঘলকদের আমলে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় সবচেয়ে বেশি। মুহাম্মদ বিন তুঘলকের ২৫ বছরের শাসনামলে কেবল দিল্লিতেই প্রায় এক হাজার মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। ফিরোজশাহ তুঘলক (১৩৫১-১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর রাজত্বকালে শিক্ষা খাতে মোট ১,৩০,০০,০০০ তংকা ব্যয় করেছেন। এ থেকে আলিম ও শিক্ষকরা পেয়েছেন ৩৬,০০,০০০ তংকা। অবশিষ্ট অর্থ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, গ্রন্থ সংগ্রহ, গ্রন্থ প্রকাশনা ইত্যাদি কাজে ব্যয় করা হয়।
মোগল আমলে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা
১১৯৭ সালে বখতিয়ার খিলজির সামরিক অভিযানের পর থেকে মাদ্রাসা ও মক্তব শাসকদের অনুদান পেতে থাকে। বখতিয়ার খিলজি নিজে এবং তাঁর পরবর্তী শাসকরাও বেশ কিছু মাদ্রাসা স্থাপন করেন।মোগল আমলে মাদ্রাসার সংখ্যা বহু গুণ বেড়ে যায়। সম্রাট বাবরের আমলের (১৫২৬-১৫৩০) রাজদরবারের কাগজপত্র থেকে জানা যায়, বাবরের প্রশাসন মনে করত, জনগণের শিক্ষা হচ্ছে শাসকের দায়িত্ব। আকবরের আমলে শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত করার জন্য একটি বিশেষ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে (১৬০৫-১৬২৭) একটি বিশেষ আইন জারি ছিল যে যখন কোনো বিদেশি নাগরিক বা কোনো দেশীয় ব্যবসায়ী কোনো উত্তরাধিকারী না রেখে মৃত্যুবরণ করতেন, তখন তার রেখে যাওয়া ভবনগুলো মেরামত করে মাদ্রাসা কিংবা অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হতো।মাদ্রাসায় শিক্ষিত উলামাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে মোগল শাসকদের। এমনকি কোনো কোনো সম্রাট আলেমদের যুদ্ধক্ষেত্রেও নিয়ে যেতেন প্রয়োজনীয় পরামর্শের জন্য।
মোগল আমলে আলেমরা প্রধানত তিনটি বিশেষ কাজে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে সহযোগিতা করতেন—এক. রাজপরিবারের শিক্ষাদীক্ষা দেওয়া, দুই. আদালতে কাজিগিরি বা বিচারকের দায়িত্ব পালন এবং তিন. সম্রাটদের বিভিন্ন রকমের দাতব্য কাজকর্মের তদারকি করা।এ বিষয়ে ইংরেজ ইতিহাসবিদ উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন, ‘কাজি অথবা মুসলমান আইনজ্ঞরা দেওয়ানি আদালতে বিচার করতেন। এমনকি আমরা যখন সর্বপ্রথম শিক্ষিত আহলে বিলাতি দিয়ে এ দেশের বিচারকাজ চালানোর চেষ্টা করলাম, তখনো মুসলমান আইনজ্ঞরা আইনের পরামর্শদাতা হিসেবে তাদের সঙ্গে রীতিমতো উঠাবসা করতেন। ইসলামী বিধিব্যবস্থাই এ দেশের আইন-কানুন ছিল এবং সরকারি ছোটখাটো অফিসগুলো মুসলমানদেরই সম্পত্তি ছিল। তারাই সরকারি ভাষা বলতে পারত এবং প্রচলিত ফারসি অক্ষরে লেখা সরকারি নথিপত্র একমাত্র তারাই পড়তে পারত।’ (উইলিয়াম হান্টার, দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, আবদুল মওদুদ অনূদিত, আহমদ পাবলিশিং হাউস, বাংলাবাজার, ঢাকা, চতুর্থ মুদ্রণ, জুন ২০০৮, পৃ. ১০৯)
ইংরেজদের আমলে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা
১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়, ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লবের পর গোটা পাক-ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ বেনিয়াদের চূড়ান্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশরা এসেই মুসলমানদের সমূলে উৎপাটনের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। তারা চিন্তা করে, রাজ্যহারা মুসলমানদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও ধর্মীয় দিক থেকে পঙ্গু ও সর্বস্বান্ত করতে না পারলে মুসলমানরা সুযোগ পেলেই ক্ষমতা দখলের লড়াই শুরু করবে। তাই তারা মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থা আমূল পরিবর্তনে মনোযোগ দেয়।
প্রথমেই তারা তৎকালীন সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী শিক্ষামাধ্যম কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ করার ফন্দি বের করে। গবেষক এ জেড এম শামসুল আলম লিখেছেন : ‘বখতিয়ার খিলজির বাংলা জয়ের পর থেকে প্রায় ৫০০ বছর পর্যন্ত সুবে বাংলা ছিল জ্ঞানচর্চার একটি কেন্দ্র। মুসলিম সুবাদার, সুলতান, নায়েব, নাজিমগণ মাদ্রাসা ও খানকার জন্য উদার হস্তে দান করতেন। নগদ অর্থ যা দিতেন, লাখেরাজ সম্পদ দিতেন তার চেয়ে অনেক বেশি।
পলাশীর যুদ্ধ, উদয়নালা-বক্সারের পরাজয়ের পর ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির নামেমাত্র মোগল বাদশা শাহ আলম সুবে বাংলার দেওয়ানি বা রাজস্বব্যবস্থার দায়িত্ব বার্ষিক ২৬ লাখ টাকার নজরানার বিনিময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন। ১৭৬৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সম্পাদিত নবাব মীরজাফর ও রবার্ট ক্লাইভ চুক্তিমূলে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি নবাব মীরজাফরকে আদায়কৃত রাজস্ব থেকে প্রদান করত ৫৩,৮৬,১৩১ টাকা। এ সামান্য টাকার বিনিময়ে বাংলার জনগণের ভাগ্য বিক্রয় হয়ে গেল ইংরেজদের হাতে। ইংরেজরা সুবে বাংলার খাজনা আদায়ের দায়িত্ব পেয়ে লক্ষ করে যে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় ৮০ হাজার মক্তব ও মাদ্রাসা ছিল। এই ৮০ হাজার মক্তব, মাদ্রাসা ও খানকার জন্য বাংলার চার ভাগের এক ভাগ জমি লাখেরাজভাবে বরাদ্দ ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি ক্রমেই এই লাখেরাজ সম্পত্তি আইন, বিধিবিধান প্রণয়ন ও জোরজবরদস্তি করে দেশের হিন্দু জমিদার ও প্রজাদের ইজারা দিতে থাকে। এ-সংক্রান্ত তিনটি বিধান হলো : (১) ১৭৯৩ সালের রেগুলেশন—১৯, (২) ১৯১৮ সালের রেগুলেশন—২, (৩) রিজামসান ল অব ১৮২৮ (লাখেরাজ ভূমি পুনঃ গ্রহণ আইন)। ফলে মাদ্রাসার আয় কমতে থাকে। বহু মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়। গুটি কয়েক মাদ্রাসা কোনো রকমে অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। ১৭৬৫ সালে বাংলায় মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল আশি হাজার। ২০০ বছর পর ১৯৬৫ সালে এ সংখ্যা দুই হাজারের নিচে নেমে আসে।’ (এ জেড এম শামসুল আলম, মাদ্রাসা শিক্ষা, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিমিটেড, চট্টগ্রাম-ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ : মে-২০০২, পৃ. ৩-৪)
এ ব্যাপারে হান্টারের বক্তব্য হলো, ‘শত শত মুসলমান পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল এবং তাদের শিক্ষাপ্রণালী, যা এত দিন লাখেরাজ ওয়াকেফর জমিজমার ওপর নির্ভরশীল ছিল, মারাত্মক আঘাত পেল। মুসলমান আলিম-সমাজ (ওয়াকেফর জমিজমার মামলা নিয়ে) প্রায় আঠারো বছরের হয়রানির পর একেবারে ধ্বংস হয়ে গেল।’ (ইন্ডিয়ান মুসলমানস, পৃ. ১২১-১২২)
কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী ছিল, তা বোঝার জন্য হান্টারের মূল্যায়ন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। হান্টার লিখেছেন : ‘এ দেশটা আমাদের হুকুমতে আসার আগে মুসলমানরা শুধু শাসন ব্যাপারেই নয়, শিক্ষা ক্ষেত্রেও ভারতের শ্রেষ্ঠ জাতি ছিল। ভারতের যে প্রসিদ্ধ (ইংরেজ) রাষ্ট্রনেতা তাদের ভালোভাবে জানেন, তাঁর কথায় : ভারতীয় মুসলমানদের এমন একটা শিক্ষাপ্রণালী ছিল, যেটা আমাদের আমদানি করা প্রণালীর চেয়ে নিম্ন হলেও কোনো ক্রমেই ঘৃণার যোগ্য ছিল না। তার দ্বারা উচ্চস্তরের জ্ঞান বিকাশ ও বুদ্ধিবৃত্তি পরিচ্ছন্ন হতো। সেটা পুরনো ছাঁচের হলেও তার ভিত্তিমূল সুদৃঢ় ছিল এবং সেকালের অন্য সব প্রণালীর চেয়ে নিঃসন্দেহে উত্কৃষ্ট ছিল। এই শিক্ষাব্যবস্থায়ই তারা মানসিক ও আর্থিক প্রাধান্য সহজেই অধিকার করেছিল।’ (ইন্ডিয়ান মুসলমানস, পৃষ্ঠা-১১৬)
এদিকে কওমি ধারার শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে ইংরেজরা মুসলমানদের ধর্ম শেখানোর জন্য কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে। এ জেড এম শামসুল আলম লিখেছেন : ‘ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৮০ সালে কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতা মাদ্রাসার মুসলিম অধ্যক্ষ ছিলেন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ১৪৭ বছর পর ১৯২৭ সালে নিযুক্ত শামসুল উলামা কামালুদ্দিন আহমদ। এর আগে প্রথম অধ্যক্ষ ড. এ স্পেনজার থেকে আলেকজান্ডার হেমিলটন হার্লি পর্যন্ত ২৫ জন অধ্যক্ষ ছিলেন ইংরেজ নাছারা। ১৭৮০ সালে মাদ্রাসা স্থাপিত হওয়ার পর ১৭৯০ পর্যন্ত ১০ বছর কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার পাঠ্যতালিকায় দারসে নেজামিয়া অনুসরণ করা হয়েছিল। অতঃপর মাদ্রাসা সিলেবাস থেকে হাদিস, তাফসির বাদ দেওয়া হয়। ১১৮ বছর পর ১৯০৮ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় হাদিস, তাফসির শিক্ষা চালু করা হয় এবং সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে নাম দেওয়া হয় টাইটেল।’ (মাদ্রাসা শিক্ষা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪)
ইংরেজদের দুই ধারার শিক্ষার বিপরীতে ১৮৬৬ সালে তৎকালীন আলেমসমাজের উদ্যোগে ভারতের দেওবন্দে বিশ্বের প্রথম কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে উপমহাদেশে তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়।
কওমি মাদ্রাসার গোড়াপত্তন
ঐতিহাসিকগণ রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ইসলামী শিক্ষা তথা ক্বওমী মাদরাসা শিক্ষাকে ৫ টি ধাপে ভাগ করে থাকেন৷ যথা :
১. খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধে সূচনাকাল থেকে ১১৯৭ খৃষ্টাব্দে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা পর্যনত্ম ছয়শত বছরেরও অধিককাল ৷
২. ১১৯৭ খৃ: হতে ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে বৃটিশ কর্তৃক ক্বওমী মাদরাসা রহিত করে তদস্থলে পাশ্চাত্য সেকুলার শিক্ষা প্রবর্তন পর্যন্ত ( সর্বমোট ৫৬৮ বছর।
৩. ১৭৬৫ খৃ: হতে ১৮৬৬ খৃ: দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত ৷
৪. ১৮৬৬ খৃ: হতে ১৯৪৭ খৃ: (৮১) বছর৷
৫. ১৯৪৭ খৃ: হতে চলমান কাল পর্যন্ত ৷
১১৯৭-১৭৫৭ মুসলিম শাসনামলকে ইসলামী শিক্ষার স্বর্ণযুগ বলা হয়৷ প্রাথমিক যুগ হতে এ শিক্ষা মসজিদ ও খানকাহ ভিত্তিক হলেও পরবর্তীতে আলাদা ক্যাম্পাস ও ভবনের প্রচলন ঘটে৷ তখনকার আমলে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে প্রচলিত কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক এক পরিপূর্ণ এ্যাডুক্যাশনাল কারিকুলাম চালু ছিল৷ এ কারিকুলামের অধীনে প্রাইমারী লেভেল থেকে ইউনিভার্সিটি লেভেল পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষা হিসেবে প্রচলিত ও স্বীকৃত ছিল এ ক্বওমী মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা৷
বাংলায় সর্ব প্রথম ইসলামী উচ্চ শিক্ষার প্রবর্তন করেন প্রখ্যাত বুযর্গ, বিদগ্ধ হাদীস বিশারদ ও মুজাহিদ শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামাহ রহ.৷ সোনারগাঁও-এ তাঁর প্রতিষ্ঠিত ক্বওমী মাদরাসা সারা ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়ে বিশ্বময় খ্যাতি অর্জন করে৷ সোনারগাঁও মাদরাসা কেন্দ্রীক আরো উচ্চ মানের বহু মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর ও মুর্শিদাবাদসহ বাংলার বিভিন্ন এলাকায়৷
সে যুগে সমগ্র বাংলায় ছোট বড় কত মাদরাসা ছিল, তার সংখ্যা সঠিকভাবে নির্ণয় করা কঠিন৷ তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে সুবে বাংলা বৃটিশ কর্তৃত্বাধীন চলে গেলে তারা বিভিন্ন প্রকারের ৮০ হাজার মাদ্রাসা আবিস্কার করে৷ পরবর্তীতে এসব মাদরাসা বন্ধ করে দিয়ে সেগুলোর ওয়াকফিয়া সম্পদ জব্দ করে নেয় বৃটিশ সরকার৷
এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, মুসলিম শাসনামলে সুবে বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ অবৈতনিক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল বেসরকারী৷ বৃটিশ কর্তৃপক্ষ যখন বাংলার ৮০ হাজার ক্বওমী মাদরাসা বন্ধ করে দেয় এবং সেগুলোর সমুদয় সম্পদ জব্দ করে নেয়, তখন ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থায় যেমন ধ্বস নেমে আসে তেমনি মাদরাসাগুলির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কর্মচুত্য হয়ে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হন৷ অপরদিকে ইংরেজরা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্জনের স্বার্থে যেমন লুটেরা অর্থনীতি চালু করে তেমনি এদেশের শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতির কবর রচনা করে তদস্থলে পাশ্চাত্য বস্তুবাদী চিন্তা-চেতনার ধারক-বাহক সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করে৷ যা মুসলমানরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন৷
১৭৮০ খৃষ্টাব্দে কলকাতা আলীয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত কোন মুসলমানের সন্তান ইংরেজ প্রবর্তিত ও পরিচালিত কোন স্কুল – কলেজে যায়নি৷ অভিভাবকবৃন্দ মসজিদ ও কাঁচারি ঘরে সীমিত পরিসরে হলেও সন্তান-সন্ততিদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করতে থাকেন৷ কিন্তু সুচতুর ইংরেজ মুসলমানদের এ অসহযোগকে তাদের কর্তৃত্বের প্রতি বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে আখ্যা দেয়৷ এ দেশের সুশিক্ষিত মুসলমানদের বাদ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা অসম্ভব ব্যাপার বলে বুঝে ফেলে৷ তাই তারা স্বতন্ত্র ইসলামী শিক্ষার নামে ১৭৮০ খৃষ্টাব্দে কলকাতা আলিয়া মাদরাসার গোড়াপত্তন করে৷ কলকাতা মাদরাসাকে কেন্দ্র করে মুসলমানরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়৷ এ মাদারাসার সর্ব প্রথম হেড মাওলানা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, উপমহাদেশের সুপ্রসিদ্ধ ইসলামী শিক্ষা কারিকুলাম “দরসে নেযামী” প্রণেতা মোল্লা নেযামুদ্দীন রহ.’র সুযোগ্য শীষ্য মোল্লা মজদুদ্দীন৷
তিনি প্রাথমিক অবস্থায় দরসে নেযামী প্রচলন করলেও মাত্র এগার বছর পর বৃটিশ সরকার ১৭৯১ সালে ইসলামী শিক্ষার মূলভিত্তি তাফসীর-হাদীস ও উসূলে ফিক্বহকে সিলেবাসের আবশ্যিক বিষয়াবলী হতে বাদ দেয় এবং আবশ্যিক বিষয় হিসেবে আরবী গ্রামার, মানতেক, দর্শন, অংক ও জ্যোতির্বিদ্যাকে রাখা হয়৷ অপরদিকে প্রশাসনিক দায়িত্বও কেড়ে নিয়ে সম্পূর্ণ ইংরেজ কর্তৃত্বাধীন এবং তাদের ধ্যান-ধারণা পরিপুষ্ট একটি ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করে, যা সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থার মতো সেই বৃটিশ আমল থেকে সরকারী স্বীকৃতি প্রাপ্ত৷ সুতরাং, যে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা আবহমানকাল থেকে মুসলমানদের সোনালী ঐতিহ্য ও গৌরবদীপ্ত ইতিহাস লালন ও বহন করে আসছে তার কোন হিসাব সরকারী দপ্তরে নেই৷
দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা
১৭৫৭ খৃষ্টাব্দে পলাশীর ট্রাজেডী হতে ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে মোঘল সাম্রাজ্যের সর্বশেষ সম্রাট বাহাদুর শাহের পতন পর্যন্ত সারা ভারত বর্ষে বিরাজ করেছিলো এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি৷ বিশেষত: বৃটিশদের দমন নিপীড়ন ও সমপ্রসারণ নীতির ফলে তাদের একমাত্র পথের কাঁটা ও শক্তিশালী প্রতিবন্ধক হিসেবে পরিচিত আলেম-ওলামা ও স্বাধীনতাকামী দ্বীনদার মুসলমানদের অবস্থা ছিল অবর্ণনীয় ও লোমহর্ষক৷ গোটা ভারত বর্ষে বৃটিশ শাসন পাকাপোক্ত হয়ে গেলে ভারতের তত্কালীন শীর্ষ আলেম ও মুহাদ্দিস, আযাদী আন্দোলনের পুরোধা শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীর রহ. সুযোগ্য পুত্র এবং আযাদী আন্দোলন ও ইসলামী শিক্ষা -দীক্ষায় তাঁর উত্তরসূরী শাহ আব্দুল আযীয রহ. ভারত বর্ষকে ‘দারুল হারব’ (শত্রুকবলিত এলাকা) হিসেবে ফতওয়া দিলে ভারতীয় মুসলমান বিশেষত: আলেম-ওলামা আযাদী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন৷
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! আযাদী আন্দোলনের প্রথম সেনানায়ক ফতেহ আলী খান প্রকাশ সুলতান টিপু ১৭৯৯ খৃষ্টাব্দে ও ১৮৩১ খৃষ্টাব্দে সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রহ. শাহাদাত বরণ করলে ইংরেজ দস্যৃদের জুলুম-নিপীড়ন অতিমাত্রায়
বৃদ্ধি পায়৷ ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার ধারক-বাহক ও “বৃটিশ খেদাও” আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী আলেম-ওলামাই ছিলেন ইংরেজদের এক নম্বর শত্রু৷ তাই এ অভিযান নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়লো: যেমনভাবেই হোক তাদের খতম করতেই হবে৷ এ নিষ্টুর অভিযানে তারা সফলও হয়৷
১৮৬৪-১৮৬৮ খৃষ্টাব্দে প্রায় সব আলেমকে ইতিহাসের নির্মমতম পদ্ধতিতে হত্যা করে৷ উজাড় হয়ে যায় লাখ লাখ ক্বওমী মাদরাসা৷ ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দে শাহ ওয়ালী উল্লাহ রহ. কর্তৃক প্রতিষ্ঠত দিল্লীস্থ মাদরাসা রহীমিয়া বুলডোজার দিয়ে ধুলিস্যাত্ করে দেয়৷ এভাবে প্রায় সকল মাদরাসা ধবংস করে দেয় বৃটিশরা৷ এমতাবস্থায় ওলামায়ে কেরামের মধ্যে যারা অবশিষ্ট ছিলেন, তারা আন্দোলনের ধরণ পরিবর্তন করলেন৷ ইংরেজদের কোপানল থেকে ভারতীয় মুসলমানদের সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া ওলামায়ে কেরাম স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, আর রক্ত ও রক্তক্ষরণ নয় মেধা ও মণীষার সংরক্ষণই হবে বুদ্ধিমানের কাজ৷
এই অভিনব মহাকৌশলের উদ্ভাবক ছিলেন হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত আল্লামা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবী রহ.৷ তিনি স্বীয় শিষ্য, সহচর ও শুভাকাঙ্খীদের সমন্বিত প্রয়াসে ১৮৬৬খৃ: ১২৮৩ হি: উত্তর প্রদেশের সাহারাণপুর জেলাধীন দেওবন্দ নামক অখ্যাত গ্রামে ভিত্তি স্থাপন করলেন সমকালীন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ইসলামী বিদ্যাপীঠ দারুল উলূম দেওবন্দ৷
ইসলামী শিক্ষা তথা ক্বওমী মাদরাসা শিক্ষার ঐতিহ্য ও গৌরব পূণরুজ্জীবিত করণে দারুল উলূম দেওবন্দের অবদান যেমন অবিস্মরণীয় ও বিস্ময়কর, তেমনি ‘‘বৃটিশ খেদাও আন্দোলনে’’ এর ভূমিকাও ছিলো অগ্রগণ্য৷ ইংরেজদের দুর্ভিসন্ধিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের কারণে এদেশে ইসলামের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক-বাহক ক্বওমী মাদরাসার শিক্ষা বিলুপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছিল৷ দারুল উলূম দেওবন্দ শুধু ভারতবর্ষে তার মিশন বাসত্মবায়নে সফল হয়েছে তা নয়; বরং আফ্রো-এশিয়ার বিভিন্ন দেশে (বিটিশ উপনিবেশসমূহে) এ শিক্ষার ব্যবস্থা প্রচলন ঘটাতে সক্ষম হয়৷
আজ সারাবিশ্বে ক্বওমী চিন্তাধারার লাখো মাদরাসা ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর নিরলস খিদমত করে যাচ্ছে৷ ক্বওমী ও আলীয়া উভয় ধারার সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত প্রায় কিতাবের ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করেছেন দেওবন্দী আলেমগণ৷ এতদ্ব্যতীত বহুমূল্যবান কিতাবের বিভিন্ন ভাষায় সরল ও সফল অনুবাদ করে অনুবাদ শিল্পে নতুন সংযোজন করেছেন তাঁরা৷ দাওয়াত ও তাবলীগের ক্ষেত্রে বিশ্বময় তাবলীগী জামাআতের অবদান অস্বীকার করা যায় না৷ তাবলীগী জামাআতের প্রণেতা ও রূপকার ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দেরই কৃতি ছাত্র হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াছ রহ.৷
অতএব, ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত সত্য হচ্ছে, ক্বওমী মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামের মৌলিকত্ব ও স্বকীয়তা সংরক্ষণের মাধ্যমে দ্বীনি দাওয়াত ও তা’লীম-তারবিয়াতের এক বিশ্বজনীন ইসলামী মিশন৷ গোটা ভারতবর্ষ যখন বর্বর বৃটিশের হাতে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও গোটা জাতি সত্মব্ধ, তখনই বৃটিশ তাড়ানোর অদম্য বাসনা নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণা দেন বিশ্ববরেণ্য ইসলামী চিনতাবিদ ও মুহাদ্দিস, ক্বওমী মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় সুশিক্ষিত আলেমে দ্বীন, দিল্লীর রহীমিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ.৷
পরবর্তীতে তাঁর উত্তোলিত স্বাধীনতা সংগ্রামের ঝান্ডা সমুন্নত রাখেন তাঁরই সুযোগ্যপুত্র শাহ আব্দুল আযীয রহ., শহীদে বালাকোট সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রহ. হযরত মাওলানা ইসমাঈল শহীদ রহ., হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী রহ., হাফেজ যামেন শহীদ রহ., মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতুভী রহ., মাওলানা রশীদ আহমদ গংগুহী রহ., হাজী শরীয়তুল্লাহ, ফাতেহ আলী (সুলতান টিপু), নেসার আলী তিতুমীর, মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রহ. প্রমূখ৷
১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে রক্তস্নাত আযাদী আন্দোলনের কাঙ্খিত ফল “স্বাধীনতা” অর্জিত হয় ১৯৪৭ সালে৷ শাহ ওয়ালী উল্লাহর হাতে সূচিত ঐতিহাসিক আযাদী আন্দোলন কিছু দিন পরে হলেও দারুল উলূম দেওবন্দের কৃতিসনত্মান শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান, হযরত সৈয়দ হোসাইন আহমদ মাদানী প্রমূখের হাতেই পূর্ণতা লাভ করে৷ আলেম-ওলামা ও ইসলাম প্রিয় মুসলমানদের রক্তঝরা আন্দোলনের ফসল স্বাধীনতাপূর্ব বৃহত্তর পাকিস্তান এবং আজকের স্বাধীন-সার্বভৌম দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশ স্ব-মহিমায় বিদ্যমান৷
বাংলাদেশে মাদ্রসা শিক্ষা
১৭৮০ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারত উপমহাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে আলিয়া ধারার মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার শুভ সূচনা হয়। পর্যায়ক্রমে অবিভক্ত বাংলা, বিহার, আসাম ও ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মাদ্রাসা শিক্ষা সম্প্রসারিত হতে থাকে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী ও কর্মমুখী করার উদ্যোগ গৃহীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড গঠিত হয় এবং ঢাকাস্থ সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ক্যাম্পাসে এর কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭৮ সালে মাদ্রাসা শিক্ষা অর্ডিনেন্স জারির মাধ্যমে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়। ফলশ্রুতিতে ১৯৭৯ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে রূপ পরিগ্রহ করে। এরপর হতে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড তার কার্যক্রম সাফল্যের সাথে পরিচালনা করে আসছে।
কওমি মাদ্রাসা
এ দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো কয়েকটি ধারা অনুসরণ করে। বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড দাবি করে, তারা হাজার হাজার কওমি মাদ্রাসার প্রতিনিধিত্ব করে। তাদের মতে, কওমি মাদ্রাসাশিক্ষার তিনটি ধাপ রয়েছে: প্রথম ধাপকে প্রয়োজনীয় ধাপ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং এই ধাপ সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক ধাপের সমতুল্য। এই ধাপের মেয়াদ ১০ বছর। দ্বিতীয় ধাপকে উচ্চশিক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই ধাপের মেয়াদ ছয় বছর এবং স্নাতক পর্যায়ের সমতুল্য। তৃতীয় ধাপটি গবেষণাধর্মী এবং এই ধাপের কোনো সুনির্দিষ্ট মেয়াদ নেই। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার অনুসরণে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড শিক্ষাক্রমকে ১৬টি ধাপে বিভক্তও করেছে। এই ধাপগুলোকে আবার পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে এবং এরই ভিত্তিতে শিক্ষার্থীরা সমন্বিত একক (Standardized) সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এই পরীক্ষাসমূহ পরিচালনা করে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। এই পর্যায়গুলো হচ্ছে মারহালাতুল ইবতেদায়ি (প্রাথমিক সমপর্যায়ের); মারহালাতুল মুতাওয়াসিথা (মাধ্যমিক সমপর্যায়ের); মারহালা সানুবিয়াহ উলাইয়া (উচ্চমাধ্যমিক সমপর্যায়ের); মারহালাতুল ফজিলাত (স্নাতক সমপর্যায়ের) এবং মারহালাতুল তাকলিম ।
এটা বলা যাবে না যে কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যসূচিকে সকল প্রতিষ্ঠানের জন্য একই ধরনের করার কোনো চেষ্টা করা হয়নি। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা বোর্ড গঠনের বিক্ষিপ্ত ও আঞ্চলিক প্রচেষ্টা এসব প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষাগুলোকে সমন্বয় করার যে চেষ্টা, তার ইঙ্গিত বহন করে। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বা কওমি মাদ্রাসা বোর্ড ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। কওমি মাদ্রাসাগুলোর পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষাগুলোকে তত্ত্বাবধান করার জন্য জাতীয় পর্যায়ের একটি কর্তৃত্বকে সংগঠিত করার সাম্প্রতিক প্রচেষ্টায় এই বোর্ড অগ্রণী ভূমিকায় ছিল।২১ এই বোর্ডের বক্তব্য অনুযায়ী ৯০০০ নিবন্ধিত মাদ্রাসা এই বোর্ডের সদস্য হিসেবে তাদের পাঠ্যক্রম ও বই অনুসরণ করে।২২ সুতরাং, কওমি মাদ্রাসা একই ধাঁচের করার প্রচেষ্টা আলেমদের জন্য কোনো বিচ্ছিন্ন ধারণা নয়। তাঁরা যেটা বিরোধিতা করেন তা হলো পাঠ্যক্রম নির্ধারণের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব। তাঁদের যুক্তি হলো এসব প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য ইসলামি পণ্ডিত তৈরি করা। তাই কোনটা ইসলামি জ্ঞান, তা নির্ধারণ করার এখতিয়ার শুধু আলেমদেরই আছে। কওমি মাদ্রাসার সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন আলেম বলেন, ‘মাদ্রাসার আসল উদ্দেশ্য হলো কোরআন ও হাদিস শিক্ষা দেওয়া এবং ইসলামি শিক্ষার ভিত্তি ধরে রাখা। প্রধান জোরটা দেওয়া হয় আরবি ভাষায়, যেন বাচ্চারা টেক্সট ভালোভাবে বুঝতে পারে। অনেকেই চাকরি পাওয়ার জন্য ডিগ্রি নিতে চায়। যদি তারা এটা চায়, তাহলে তারা তাদের সন্তানদের আলিয়া মাদ্রাসায় পাঠাবে। কিন্তু যারা শুধু ইসলাম চায়, তারা কওমি মাদ্রাসায় আসবে’ (বানো, ২০০৮, পৃ. ২৭)। কওমি মাদ্রাসাব্যবস্থার সমর্থকেরা এ-ও বলেন যে সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার অভাব রয়েছে। সে জন্য এই দুই ব্যবস্থার মধ্যে সমকক্ষতা প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এ অবস্থায় তারা এমন সুপারিশও করে না যে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসাব্যবস্থায় কিছু পর্যায় পড়ে সেক্যুলার ব্যবস্থায় তাদের শিক্ষা চালিয়ে যেতে পারবে। কিছু কিছু ওলামা যুক্তি দেন যে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে তাদের ইসলামি চরিত্র হারিয়ে ফেলবে এবং এই ব্যবস্থাও তাদের সহপাঠীদের প্রভাবে নষ্ট হয়ে যাবে।২০১৭ সালে বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রিকে মাস্টার্সের সমান মর্যাদা দেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ।
রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক
১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে বেশ কিছু সংস্কার এবং পরিবর্তনের মাধ্যমে আলিয়া মাদ্রাসাগুলোকে মূলধারার সর্বজনীন সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে একীভূত করা হয়। অন্যদিকে, আলেমদের নিজেদের ইচ্ছায়ই কওমি মাদ্রাসাগুলো রাষ্ট্রীয় তদারকির বাইরে থেকে যায়। পাকিস্তানের ইসলামি-রাষ্ট্র মতবাদের বিরোধিতা করে বাঙালি নৃ-জাতীয়তাবাদী (ethno-nationalist) আন্দোলনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও এবং স্বাধীনতার পর সংবিধানে সেক্যুলারিজমকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে বলা হলেও, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকার বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে গেছে। ১৯৭৪ সালে অধ্যাপক কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশনের তৈরি করা শিক্ষানীতিতে জাতীয়তাবাদী ধারণাসমূহকে, বিশেষভাবে সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদ সঞ্চারিত করাকে শিক্ষার উদ্দেশ্য হিসেবে দেখা হয়েছিল। যদিও কমিশন সংবিধানের আলোকে একটি অভিন্ন শিক্ষাপদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশনা দিয়েছিল, কিন্তু কমিশন তার প্রতিবেদনে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ (মাদ্রাসাসমূহ) বিলোপের সুপারিশ করেনি। একই সঙ্গে, বেসরকারিভাবে পরিচালিত ইংরেজি ভাষার কিন্ডারগার্টেনগুলো বিলোপের পরামর্শও কমিশনের প্রতিবেদনে ছিল না। ১৯৭২ সালে সব ধরনের ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, ফলে তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মীয়-রাজনৈতিক শক্তিগুলো উপস্থিত ছিল না। ধর্মীয় শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত সাধারণ শিক্ষার অংশ করার সুপারিশ করেছিল কমিশন, কারণ দেশের শিক্ষিত এলিটরা এ ধরনের একীভূতকরণের পক্ষপাতী ছিলেন।১৭ এরই ধারাবাহিকতায় এখন পর্যন্ত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে ধর্মীয় শিক্ষা (মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য ইসলাম শিক্ষা এবং হিন্দু শিক্ষার্থীদের জন্য হিন্দু ধর্মীয় পাঠ) অন্তর্ভুক্ত আছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে সরকার মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডকে কার্যক্রম পরিচালনা, পাঠ্যক্রম সুপারিশ এবং সমন্বিত একক পরীক্ষাগুলো আয়োজনের অনুমতি প্রদান করে।১৮ ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় আসে; এরপর থেকে মাদ্রাসাগুলো সরকারি সহায়তা পাওয়া শুরু করে। ১৯৭৫ সালের শেষের দিকে মাদ্রাসা বোর্ড ফাজিল ও কামিল ডিগ্রির পাঠ্যক্রম পুনরালোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই পাঠ্যক্রম পুনরালোচনার উদ্দেশ্য ছিল: জাতীয় শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তকগুলো মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা এবং নির্বাচিত কিছু মাদ্রাসায় আলিম ও ফাজিল পর্যায়ে আলাদা বিজ্ঞান বিভাগ চালু করা।১৯ সত্তর ও আশির দশকজুড়ে সামরিক শাসকেরা শিক্ষা খাতের ইসলামীকরণে প্রকাশ্য চেষ্টা চালিয়েছেন। যেমন ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যক্রম-বিষয়ক কমিটি নিযুক্ত করে, যেখানে ঘোষণা করা হয়, ‘ইসলাম একটি জীবনবিধান, শুধু আনুষ্ঠানিকতার সমষ্টি নয়। একজন মুসলমানকে শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক জীবন ইসলামের আদর্শ অনুযায়ী পরিচালনা করতে হবে। সুতরাং, ইসলামি জ্ঞানার্জন নারী-পুরুষ সব মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক’ (বাংলাদেশ সরকার, ১৯৭৮, পৃ. ১৪৯)।
প্রাথমিকভাবে রাজনৈতিক কারণে যেহেতু সামরিক সরকার ইসলামি বাগ্ধারা ব্যবহার করতে শুরু করেছিল এবং সমাজের ইসলামীকরণে মনোযোগী হয়েছিল, তাই ইসলামের অর্থ সংজ্ঞায়িত করা এবং ইসলামি শিক্ষার কর্তৃত্বের ওপর একধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। এর ফলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি স্বতন্ত্র দপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং মাদ্রাসাশিক্ষার তত্ত্বাবধানের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এই বোর্ডের ওপর মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম এবং পরীক্ষাগুলোকে একই ধাঁচের করার দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। মাদ্রাসাশিক্ষাকে সেক্যুলার সাধারণ শিক্ষার সমমানের করে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয় মাদ্রাসা বোর্ডকে। এর ফলে মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদেরও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ তৈরি হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির নেতাকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করে। ১৯৮৭ সালের মধ্যে দাখিল ও আলিম ডিগ্রিকে সেক্যুলার শিক্ষাসনদের সমমর্যাদা দেওয়া হয় এবং ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক সনদ গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়।
এ ব্যাপারে আলেমদের কাছ থেকে তেমন কোনো প্রতিরোধ আসেনি। এর ফলে আলিয়া মাদ্রাসাকে মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় সহযোজিত করার ক্ষেত্রে সরকার সফল হয়। সংস্কারের ব্যাপারে প্রতিরোধের অভাব/অনুপস্থিতির বেশ কিছু কারণ ছিল। এর মধ্যে আলিয়া মাদ্রাসাব্যবস্থার ঐতিহাসিক পথপরিক্রমা অন্তর্ভুক্ত (এই ব্যবস্থা ১৭৮০ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে গেছে)। মাদ্রাসার সঙ্গে সম্পৃক্তরা এই একীভূতকরণকে একটি সুযোগ হিসেবে দেখেছিল, যার ফলে একাধারে ছাত্রছাত্রীদের ধর্মীয় শিক্ষাও দেওয়া যাবে, আবার তাদের সমাজের উত্পাদনশীল ও সক্রিয় সদস্য হিসেবেও প্রস্তুত করা যাবে। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত আলেমরা বললেন যে আলিয়া ব্যবস্থা দিনি শিক্ষা ও দুনিয়াবি শিক্ষা দুটোকে একত্র করেছে, অন্যভাবে বললে যা দাঁড়ায়, আল-উলুম আল-নাকিলয়া (প্রেরিত বিজ্ঞান) এবং আল-উলুম আল-আকলিয়া (যুক্তিবিজ্ঞান) দুই ধরনের জ্ঞানই একটি সামগ্রিক এককের অংশ। এভাবে তাদের শিক্ষার্থীরা একজন সত্যিকারের মুসলমান হওয়ার চেতনাকে গ্রহণ করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এবং এই সম্পর্ক এখন বেশ প্রতিষ্ঠিত।
মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় আলিয়া মাদ্রাসাকে একীভূতকরণের তাত্পর্যপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ‘১৯৮০ সাল থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ে সর্বমোট শিক্ষার্থী নিবন্ধনের ক্ষেত্রে, মাদ্রাসা খাত তার সমপর্যায়ের সেক্যুলার খাতের চেয়ে দ্রুত বেড়েছে’ (বিশ্বব্যাংক, ২০১০, পৃ. ১১)। দুটি নীতি নেওয়ার ফলে এই বৃদ্ধি ঘটেছে: মাদ্রাসাশিক্ষকদের জন্য বেতন ভর্তুকির বিধান (সেক্যুলার সরকারি স্কুলের মতো) এবং মেয়েশিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান।২০ শেষেরটি আবার মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সংখ্যাগত লিঙ্গ সমতায় প্রভাব ফেলেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘সর্বমোট মাদ্রাসা শিক্ষার্থী নিবন্ধনে মেয়েশিক্ষার্থীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে, যা ১৯৯০ সালে ১০ শতাংশেরও কম থেকে ২০০৫ সালে ৫০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে’ (বিশ্বব্যাংক, ২০১০, পৃ. ১১)।
যদিও সংস্কার কার্যক্রমের ফলে মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়েছে, এগুলোকে টেকসই করেছে এবং আগে সমাজের যেসব অংশ বঞ্চিত ছিল সেখানে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে, তবুও সংশ্লিষ্ট সব আলেমকে সন্তুষ্ট করা যায়নি। আলেমদের বড় একটি অংশ মাদ্রাসা খাতের এই সংস্কারকে তাদের কর্তৃত্বের ওপর হুমকি হিসেবে দেখে এবং ফলে তারা ‘ইসলামি জ্ঞান’ সংরক্ষণের কায়দা হিসেবে আরও বেশি কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে। গত তিন দশকে একদিকে আলিয়া মাদ্রাসা মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে অনেক বেশি একীভূত হয়েছে, অন্যদিকে আলেমরা গ্রামীণ অঞ্চলে বহুসংখ্যক কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁদের যুক্তি হলো, ইসলামি জ্ঞান ও ইসলামি কর্তৃত্বকে ধ্বংস করাই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। সাধারণত বলা হয়ে থাকে যে এসব প্রতিষ্ঠান, পাঠ্যক্রম ও শিক্ষাদান পদ্ধতির ক্ষেত্রে অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। এ ছাড়া ইসলামি শিক্ষার ‘বিশুদ্ধতা’ এবং ইসলামি ঐতিহ্য প্রবাহিতকরণের ‘আদি’ পদ্ধতি বজায় রাখার দায়িত্ব তাঁদের এই ধারণার ফলে তাদের মধ্যে এমন এক মানসিকতা তৈরি হয়েছে, যা বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসায় পরিবর্তনের অনুকূল নয়, বরং প্রতিকূল।
Leave a Reply