ইসলাম, বিসমিল্লাহ, ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি
ধর্মনিরপেক্ষতা মানে, ‘গেল গেল ধর্ম গেল’ যারা বলেন আপনাদের মানসিক উন্নতির জন্য আমার এই লেখাটা। এসব গুজবের প্রতি যাদের অগাধ বিশ্বাস সেসব মানুষের চিন্তা চেতনা দেখে নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না । যাক আর কথা বাড়াবো না কাজের কথাই আসি। এই ধরণীতে অনেক রকমের জাতি রয়েছে এবং তাদের কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা রয়েছে, অন্যান্য জাতির মতো বাঙ্গালির ও নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা রয়েছে। আর এই বৈশিষ্ট্য আর কিছু না ধর্মনিরপেক্ষতা। অনেকে মনে করবেন আমি বলছি, বিশ্বাস করেন আমি বলছি না ইতিহাস বলছে। আর ঐ ইতিহাস হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাস।ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাই বাঙ্গালির হাজার হাজার বছরের ধর্মনিরপেক্ষতার।
উপমহাদেশের বঙ্গ নামক এই ভূমিতে বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের মানুষের পর্যায়ক্রমে অথবা একই সঙ্গে অবস্থান। ইতিহাসে প্রমাণিত সত্য ‘বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ছিল গুপ্ত ও মৌর্য আমলে। তবে এই আমল সম্পর্কে যথেষ্ট ঐতিহাসিক সত্যতা পাওয়া যায় নি। তবে মহাস্থান গড়ের যে স্মৃতিচিহ্ন আছে-তা ব্রাহ্মলিপির মাধ্যমে জানা যায় সেই সময়ের শাসকরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল এবং সেই আমলের জনগণও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিল। এই দুই আমলের শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতাপশালী শাসক ছিলেন অশোক, যিনি কলিঙ্গের যুদ্ধের কারণে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
উল্লেখ্য যে, তিনিও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, তিনি মৌর্য বংশের চন্দ্র গুপ্ত মৌর্যের সন্তান ছিলেন। ইতিহাস বলে তিনি যথেষ্ট প্রতাপ ও প্রতিপত্তির শাসক হওয়া সত্ত্বেও ধর্মের ব্যাপারে কোনোপ্রকার বাড়াবাড়ি করেন নি এবং এ ব্যাপারে কোনো প্রমাণ নেই।’
এর পরবর্তীতে এলো শশাঙ্কের শাসন আমল; তিনি ছিলেন শিবের উপাসক ও একজন সত্যিকারের রাষ্ট্রনায়ক। সেই আমলে শশাঙ্ক রাজ্যকে বিস্তৃত করেছিল, সমৃদ্ধ করেছিল ও শৃঙ্খলার মধ্য থেকে ছিল অমৃত্য। তিনি একজন উদার হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন এবং তার উদারতায় অনেক ছোট ছোট রাজ্য তার অধীনে থাকতে রাজি হয়েছিল। তাকেও আমরা সফল রাষ্ট্রনায়ক উপাধি দিতে পারি। কিন্তু চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর বিবরণী অনুসারে শশাঙ্ক ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দের কিছু সময় পূর্বে গায়ার বোধিবৃক্ষ কেটে ফেলেন ও তার কাছের একটি মন্দির থেকে বুদ্ধমূর্তি সরিয়ে ফেলেন। তবে বিবরণটি সম্পর্কে অনেকে ঐতিহাসিক প্রশ্ন তুলেছেন এবং বলেছেন বিষয়টি সত্য নাও হতে পারে। কারণ হিউয়েন সাং হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন।
এবারে আসা যাক পাল রাজাদের আমলের কথায়। পাল রাজারা ছিলেন ধর্ম নিরপেক্ষতার মূর্তপ্রতীক। পাল সম্রাটরা ছিলেন বৌদ্ধ; কিন্তু প্রজারা অধিকাংশ ছিল হিন্দু। পাল সম্রাট ধর্মপাল ধর্মীয় সম্প্রীতিকে রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। আজ থেকে কয়েক শত বছর পূর্বে পাল রাজারা তাদের রাষ্ট্রে সকল ধর্মের, বর্ণের লোকেরা যাতে ধর্মীয় কার্যকলাপ সম্মান ও ইজ্জতের সঙ্গে পালন করতে পারে সেটির বিষয়ে তৎপর ছিলেন এবং সেটি নিশ্চিত করেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাল প্রশাসনের রাষ্ট্রীয় উচ্চ পদের জায়গাগুলোতে ব্রাহ্মণদের উপস্থিতি লক্ষণীয়।
ধর্মপালের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ ও এই মন্ত্রীর পরিবার তিন পুরুষ ধরে পাল রাজাদের শাসনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পাল বংশের রাজারা এতই উদার ছিল, যে তারা হিন্দুদের উপাসনালয় নির্মাণে জমি দান করে ছিলেন। এটি ঐতিহাসিকভাবে সত্য। এ প্রসঙ্গে না বললেই নয় ধর্মপাল ছাড়াও নারায়ণ পাল, প্রথম মহিপাল, ন্যায়পাল ছিল ধর্ম নিরপেক্ষতার মূর্ত প্রতীক। পাল আমলে হিন্দু-বৌদ্ধদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ ছিল বলে প্রমান পাওয়া যায় নি। ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহাবস্থান ছিল এ যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য; আর এ কারণে বাংলায় পাল আমল চারশত বছর (১৭ পুরুষ ধরে) টিকে ছিল। ধর্ম নিরপেক্ষতা ধসে গেলে সমাজ ও রাষ্ট্রের কি অবস্থা দাঁড়ায় তা প্রাচীন বাংলার সেন বংশকে দেখলে বোঝা যায়। সেন বংশের রাজত্বকালে ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মের জাগরণের চেষ্টা করা হয় ও সামাজিক বিভেদের বীজ বপন করা হয়। শেষ পর্যন্ত উল্লেখিত দুই কারণে সেন বংশের পতন হয়। সেন যুগে পাল আমলের ধর্মীয় সহনশীলতা ও সমন্বয় নীতি বাতিল করা হয়। ধর্মের মাধ্যমে সমাজকে বহুভাগে বিভক্ত করা হয়। যেমনটি হয়েছিল মধ্যযুগের ইউরোপের খ্রিষ্ট্রীয় গির্জার প্রভাবে। গির্জাগুলো ইউরোপের জনজীবনকে কঠোর শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলেছিল। এখানে লক্ষণীয় যে সেন রাজারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু আচার, পদ্ধতি, রীতি, নীতি-বিবাহ সম্পর্ক জাতি ও বর্ণের কঠোর শৃঙ্খলে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে দিয়েছিল। এই নিয়মকানুন তারা তাদের পিতৃভূমি কর্নাটক (দক্ষিণ ভারতীয়) থেকে আমদানি করেছিল। সেন রাজারা কুলীন, ভাঙ্গকুলীন, অভাবকুলীন, রাঢ়ী, বৈদিক, বারেন্দ্র অসংখ্য কুলে ব্রাহ্মণদের বিভক্ত করে ফেলে। তাছাড়াও অব্রাহ্মণদেরও নানা ভাগে ভাগ করা হয়। উল্লেখযোগ্য যে, অনুগত ব্রাহ্মণদের সাহায্যে পুরাণ ও পুথি লিখিয়ে ইচ্ছামতো বিভিন্ন জাতির উৎপত্তি বর্ণনা করা এবং স্বেচ্ছাচারীভাবে কাউকে উঁচু, কাউকে নিচু বলে ঘোষণা দেয়া হয়। সমাজের জাতপাতের বিভেদটা প্রবল হয়ে ওঠে। ফলশ্রুতিতে এর আড়ালে সংখ্যালঘু একটি তথাকথিত উচ্চ বর্ণগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। যারা সমাজের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার একচেটিয়া ভাগীদার হয়ে যায়।
সমাজের নিচু তলার মানুষ শ্রেণী নির্যাতনের শিকার হয়। জাতিভেদ প্রথা কঠোর রুপধারণ করে; হেতু সমাজিক সংহতি ও ঐকতান ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ধর্মকে রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীর মধ্যে এনে বৃহৎ এক শ্রেণীকে বঞ্চিত করায় সুবিধাভোগী শ্রেণী ও বঞ্চিত শ্রেণী বখতিয়ার খলজীর আক্রমণের সময় এগিয়ে আসেনি। এ হচ্ছে প্রাচীন বাংলার রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব। যারা রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্ম নিরপেক্ষ থাকে, তারা বহুদিন টিকে থাকে এবং যারা ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার করেছে সাময়িক সুবিধায় থাকলেও পরবর্তীতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।
এর পরে ১২০৪ খ্রিস্ট্রাব্দে তুর্কিজাত ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মাদ বখতিয়ার খলজি বাংলাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ও ধর্মনিরপেক্ষ শাসন করেছিলেন। এর অনেক আগে করাচী বন্দর দখল করে মোহাম্মদ বিন কাশিম ধর্মনিরপেক্ষ রাজত্বের সুচনা করেছিলেন। ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশ দিল্লী সালতানাতের শাসনে ছিল। চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে পরবর্তী ২শ’ বছর আফগান সুলতানরা শাসন করেছে এই বাংলাদেশ।
বখতিয়ার খলজীর বঙ্গ বিজয়ের পূর্বেই মুসলমান ধর্ম প্রচারের একটি ক্ষেত্র এখানে তৈরি হয়েছিল তবে পরবর্তী প্রায় একশত বছরের ইতিহাস যথেষ্ট সুখকর ছিল না। কারণ, আবার ধর্ম প্রচারে অনেক কঠোর হয়ে তরবারি ধারণ করতে হয়েছে। কিছু শাসক ধর্মনিরপেক্ষতার ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে ভয়ঙ্কর উগ্রতার নিদর্শনও দেখিয়েছে। যেমন জাফর খান তিনি ছিলেন বীরযোদ্ধা; তিনি রুকনুদ্দীন কাই কাউসকে সুলতানী বিস্তৃত করতে সাহায্য করেছিলেন। তিনি ত্রিবেনীতে একটি বিশাল মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এই মসজিদের (১২৯৮) যে পাথর ব্যবহৃত হয়েছিল; সেসব পাথরের উল্টো দিকে আছে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি। তাছাড়া এই মসজিদের ওপর উৎকীর্ণ শিলালিপিতে তিনি গর্ব করে বলেছেন, কীভাবে তরবারি দিয়ে কাফেরদের বিনাশ করেছেন। এভাবে তিনিই প্রথম বঙ্গদেশে রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলাম ধর্মকে উগ্রভাবে ব্যবহার করে ইসলাম ধর্মের উদার নৈতিকতাকে প্রশ্ন বিদ্ধ করেছেন। ধর্মের উগ্রতা হিন্দু রাজা গণেশের মধ্যে পাওয়া যায়।
১৪১০ সালে গিয়াস উদ্দীন মারা গেলে তাঁর পুত্র সাঈফ উদ্দীন বছর খানেকের জন্য নামেমাত্র সুলতান হন। কিন্তু আসল ক্ষমতার অধিকারী হন গণেশ। ক্ষমতার তুঙ্গে থাকা রাজা গণেশ মুসলমানদের সরাসরি বিরোধিতা করতে আরম্ভ করেন। প্রতীকি পদক্ষেপ হিসেবে তিনি এসময়ে একাধিক মসজিদ ভেঙে ফেলেন। হিন্দু রাজা ক্ষমতা গ্রহণ করায় এবং মসজিদ ভেঙে মুসলমানদের কর্তৃত্বের প্রতীকী বিরোধিতা করায় মুসলমান আমীরওমরারা স্বাভাবিকভাবেই তাঁর বিরোধিতা করতে থাকেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের সুলতান বলে দাবি করেন। আর মুসলমান পীরদের কেউ কেউ এসময়ে বিহারের সুলতানকে বঙ্গদেশ অধিকার করার আহ্বান জানান। এই পরিস্থিতিতে রাজা গণেশ অনুভব করেন যে, মুসলমান আমীরওমরাদের প্রত্যক্ষ বিরোধিতার মুখে একজন হিন্দু রাজার পক্ষে রাজত্ব চালানো খুব সহজ হবে না। সেই জন্য তিনি তাঁর বারো বছরের পুত্র যদুকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা দিয়ে সিংহাসনে তুলে দেন এবং তাঁরই নামে রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। পুত্রের নতুন নাম হয় সুলতান জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ। মুঘল আমল ছিল উপমহাদেশের অন্যতম ঐতিহাসিক শাসনব্যবস্থা।
এই আমলে মসজিদের সংখ্যা কমে গেলে মন্দিরের সংখ্যা বাড়েনি। কারণ, তারা মন্দির নির্মাণে তেমন সহযোগিতা দেননি। তাছাড়াও তাদের শাসনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল যে তা প্রশাসনকে ধর্ম থেকে আলাদা করে রেখেছিল এবং সেটি কঠোরভাবে মেনে চলেছিল। মুঘল আমলের বেশিরভাগ শাসকই সকল ধর্মের প্রতি উদার ছিল। বাংলার দীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় রাজনীতে অর্থাৎ শাসনব্যবস্থায় ধর্মের উগ্র ব্যবহার কোনোভাবেই রাষ্ট্রের জন্য শুভ ফল বয়ে আনেনি। যারা কূটকৌশলী রাজনীতিবিদ ছিল তারা খুব সহজে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের ব্যবহার করে একটি সস্তা জনপ্রিয়তা আনার চেষ্টা করেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে তার মাশুল দিতে হয়েছে। ঐ সময়ে জন্মলাভ করে পণ্ডিত অতিশ দীপঙ্কর। যিনি সেই যুগের বাংলার মনিষী ছিলেন। সেই সময়ে ও পাল রাজারা ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন।
মুসলিম সুলতানদের সহযোগিতাই ও পৃষ্টপোষকতাই ‘মহাভারত’ ও ‘ ভগবদগীতা’ প্রথমবারের মত সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষাই অনুদিত হই। সেই সময়ে কবিদের রচনাই ‘শুনহ মানুষ ভাই…সবার উপরে মানুষ সত্য …তাহার উপরে নাই।’ পনের শতকে বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাস ও এই অমর বানীতে গান গেয়েছিলেন। এই দেশে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় অসহিঞ্চুতা কখনও জনমনে দানা বাঁধতে পারেনি। উনিশ শতকে ফকির লালন শাহ এর গানে উদার মনোভাব দেখা যাই। ফকির লালন শাহ এর গানে ‘সব লোকে কই লালন কি জাত সংসারে……’, এই দেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাই ‘কাট মউলানা’ বা ‘রক্ষণশীল মোল্লাদের’ চেয়ে ধর্ম প্রচারে সূফী, দরবেশরা ও সাধকরা অনেক কার্যকরী ভুমিকা পালন করেছিলেন এবং উনাদের আদর্শ ছিল সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতা। ব্রিটিশরা এসে আবার সাম্প্রদায়িকতার বিস্ফোরণ ঘটান। এরপর মোহাম্মাদ আলি জিন্নাহ হিন্দু-মুসলমান মিলন ঘটানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন প্রথমদিকে সফল হলেও পরে সফল হননি। কিন্তু তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার কঠিন সমর্থক ছিল।
১৯৪৭ এ দেশ বিভাগের পর রাষ্ট্রে জনগণের অধিকার এর বিষয় নিয়ে তার সিদ্ধান্ত ছিল সব ধর্মের মানুষ সমান অধিকার পাবেন। ১৯৪৮ সালে ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নার মৃত্যুর পরে পাকিস্তানে ধর্মীয় প্রভাব বেড়ে গিয়েছিল। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তানের সংবিধান এর মূল ভিত্তি হিসেবে ‘Sovereignty belongs to Allah’ কথাটি প্রথম উল্লেখ করা হয়।এর পরে জেনারেল ইস্কান্দর মির্জা যখন গভর্নর জেনারেল ও পরে প্রেসিডেন্ট হলে প্রথম সংবিধান রচনা করেন এবং সেটিতে পাকিস্তান কে ‘Islamic Republic of Pakistan’ বলে ঘোষণা করা হয়। এবং এই সংবিধান বাস্তবায়ন করার আগে বাতিল (void) বলে খেতাব পায়। এরপর ১৯৫৮ সালে সামরিক সিডেন্ট আইয়ুব খান ও জেনেরাল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানকে ‘Islam based Ideological State’ বলে চেঁচামেচি করতেন এবং তাদের শাসন কালে ‘Islamic Law’ চালু করার কোন চেষ্টা ছিলনা। তাদের ব্যক্তিগত জীবনে তারা ২ জনেই কি কি (অনৈসলামিক) কাজে বিখ্যাত ছিলেন তা সারা পাকিস্তান জানে। এরপরে জেনারেল জিয়াউল হক সম্পূর্ণ অবৈধভাবে জুলফিকার আলী ভূট্টোর বেসামরিক নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে যখন রাষ্ট্রীয় গদি দখল করলেন তখন নিজের স্বার্থে ও তার অবৈধ ক্ষমতাকে বাঁচানোর জন্যে ইসলামী রাষ্ট্র করার প্রক্রিয়া শুরু করেন ।
পাকিস্তান আন্দোলনের সময় থেকে শেষ পর্যন্ত জিন্নাহ, লিয়াকাত আলী ও জুলফিকার আলী ভূট্টো পর্যন্ত সকল রাজনৈতিক নেতা তাদের বক্তব্যে ‘বিসমিল্লাহ’ দিয়ে শুরু করতেন না এমন কি কোরাআন তেলাওয়াতের ও রেওয়াজ ছিল না। আমাদের নেতারা শের -এ-বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান রাজনৈতিক বক্তব্য ‘বিসমিল্লাহ্’ দিয়ে শুরু করতেন না । স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান তিনি এক সময় মুসলিম লীগের রাজনীতি করেছেন এবং ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হলে তিনি যুগ্ম সম্পাদক নিযুক্ত হন। এর পরে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জাতিভিত্তিক সমাজ নির্মাণে ও আদর্শ জাতি গঠনে ধর্মনিরপেক্ষতার বিকল্প নেই। সেই চিন্তা করে ১৯৫৫ সালে মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ সংগঠনে রুপ দেয়ার পেছনে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের ভুমিকা অপরিসীম ।
এখন একটু বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পারিবারিক উত্তরাধিকার সুত্রে যে স্থান পেয়েছিলেন তা হলো ভারতের মুসলিম শাসনামলে সামাজিক সাংস্কৃতিক বিকাশে এবং ইসলাম ধর্মবিস্তারে সুফিমত সম্মত ধর্মনিরপেক্ষতার জ্ঞান। বাঙালি জাতির আধুনিকতাই প্রবেশের একমাত্র পন্থা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ স্থান। বঙ্গবন্ধু ভুখা মিছিল থেকে গ্রেফতার থেকে বিরত থাকার জন্য পালিয়ে যান পশ্চিম পাকিস্থান এবং সেখানে তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে থাকেন। দিনের পর দিন তারা ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনামলে ধর্মবিস্তার ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনা করেন। ঐ আলোচনায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধুকে বলেন ‘সাম্প্রদায়িকতা থেকে জাতিকে মুক্ত না করতে পারলে জাতির আত্নবিকাশ ঘটবে না । জাতীয়তাবাদের আধুনিক বিকাশের জন্য চাই ধর্মনিরপেক্ষতা।’
(বঙ্গবন্ধুর সাথে খন্ধকার মোহাম্মাদ ইলিয়াসের সাক্ষাৎকার ও মুসলিম শাসনকাল ধর্মনিরপেক্ষতা ও বঙ্গবন্ধু – ১২০৬- ১৯৭৫: আবু আল সাইদ ,১৯৯৭) এবার বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা আলোচনা করা যাক।
বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালের দিকে একবার কাগজের দুস্প্রপতার জন্য কোটার বাবস্থা করেছিলেন কিন্তু ধর্মীয় বিষয়ে পুস্তিকা ছাপার প্রশ্নে কাগজ সরবরাহ অবাধ করে দিয়েছিলেন। অনেকে বলেন শুনি বঙ্গবন্ধু নাকি ইসলাম অনুসারী নয়। তাদের প্রতি আমার প্রশ্ন ? না জেনে লাফাবেন না। জেলে থেকে ও বঙ্গবন্ধু নামাজ রোজা পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালে নির্বাচনের পূর্বে রেডিও টেলিভিশনে বক্তৃতার সময় বলেন ‘লেভেল সর্বস্ব ইসলামে আমরা বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম রাসুলে করিম (দঃ) এর ইসলাম, যে ইসলাম জগতবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে বারবার যে অন্যায় অত্যাচার শোষণ, বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছেন, আমাদের সংগ্রাম সেই মোনাফেকদের বিরদ্ধে। যে দেশের শতকরা ৯৫ জনই মুসলমান যে দেশে ইসলাম বিরোধী আইন পাশের সম্ভাবনার কথা ভাবতে পারেন কেবল তারাই ইসলামকে যারা ব্যবহার করেন দুনিয়াটা ফাইস্তা করে তোলার জন্য।’ আর আপনারা জানেন ইসলামিক রিপাবলিক অফ পাকিস্তানের নেতারা মদ ছাড়া মিটিংই করেন না। এটাই তাদের আসল রূপ।
১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ারদী উদ্যানে এক ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়, মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে, হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে, খ্রিষ্ট্রান তার ধর্ম পালন করবে, বৌদ্ধ ও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই – ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে বাবসা চলবে না। ধর্মের নামে লুট করা চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার আলবদর পইদা করে বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেয়া হবে না।’
এরপরে ঐ বছরের ১২ অক্টোবর জাতীয় সংসদে প্রথম সংবিধান অনুমোদন অধিবেশনে তিনি স্পষ্ট ভাষাই বলেছিলেন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। রাজনৈতিক কারনে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না।’ যখন ৪ নভেম্বর প্রথম সংবিধান অনুমোদন পেল তখন তিনি স্বাগত ভাষণে বলেছিলেন ‘ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। কেউ যদি বলে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলবো ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।’ (বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে নেয়া)
ঐ সময়ে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি। এরপরে এই বিষয় নিয়ে তেমন কোনো ঝামেলা হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরে একদল ক্ষমতাপিপাসুরা আবার ক্ষমতাই যায় এবং পাকিস্তানের দালাদের হাতে এই দেশের পতাকা তুলে দেয়া হয়। এরপরে ঘাতকদের কথামতো বাংলাদেশ চলতে শুরু করলো। এরপর রাষ্ট্রপতি মেজর জিয়াউর রহমান এসে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ যোগ করেন শুধু রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য। সামরিক কায়দায় যারা ক্ষমতায় আসে তাদের রাজনৈতিক কৌশল এই ধরণের হয়। এরশাদ সাহেব এর ব্যতিক্রম না । তিনি ক্ষমতাই এসে জিয়াউর রহমান এর কাছ থেকে শেখা পদ্ধতি অনুসরন করে। আলহাজ হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ বাংলাদেশের মানুষের ধর্ম ঠিক করে দিলেন। হাজী সাহেব বলে কথা। সংবিধানে তিনি যোগ করলেন ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম’, একটি রাষ্ট্রের কি ধর্ম থাকতে পারে না রাষ্ট্রের মানুষের? এই হাজী সাহেব ব্যক্তিগত জীবনে কত ইসলামিক কাজ করছে তা সবাই ভালো জানেন। কিন্তু এই রাজনৈতিক কৌশলের জন্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যে আদর্শ বারবার পদদলিত হয়েছে সবার কাছে। বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন আমাদের সোনার বাংলা নিয়ে তা কি আমরা বাস্তাবায়ন করতে পারবো? সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে তারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বহাল রাখা যা সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। যদি এইভাবে হয় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র কি পারবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ভিত্তিক সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে? আজকের জঙ্গীবাদ এইসব ইস্যুতে আশকারার ফসল। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ঠিক করতে হবে রাষ্ট্র কিভাবে চলবে যেইরকম একটি ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ চলে !
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে ছিল এক এক অভিন্ন বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা, সেখানে বহু ধর্ম, বহু বর্ণ বহু জাতিগোষ্ঠী এক হয়ে থাকার লক্ষ্যে ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগকে ৯৮ ভাগ ভোট দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর যোগ্য নেতৃত্বে ১৭ বছর পরিশ্রম করে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের রূপরেখা স্বাধীনতার পূর্বেই দেখাতে সক্ষম হয়েছিল। এই আশাaকে বুকে বেঁধে বাংলাদেশের সব স্তরের মানুষের মধ্যে এক সুর বেজে উঠেছিল সেটি স্বাধীনতা। যদি বঙ্গবন্ধু একটি ধর্মের লোককে প্রাধান্য দিতেন তবে অন্য ধর্মের লোকেরা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তেন না, তারা মনে করতো যে আমরা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে আছি এবং স্বাধীনতার সূর্য খুব সহজে উদিত হতো না। সবার স্বপ্ন বাংলাদেশ হবে একটি আসাম্প্রদায়িক ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও জাতির জনকের স্বপ্নের বাস্তবায়ন।
লেখক : গবেষক, আইন অনুষদ, ইউনিভার্সিটি মালায়া, মালয়েশিয়া
Leave a Reply