আমার ভাবনায় দুখু মিয়া
শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ হয়েছে আদি থেকে সমাজের উঁচুতলার সংস্পর্শে, বাংলা সাহিত্যে এর বিভ্রম হয়নি। প্রজাদের নিজেদের অন্নের যোগানে ব্যতিব্যস্ত থাকায় শিল্প সাহিত্যে মনোনিবেশের তেমন একটা বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারেনি। ইতিহাসে দেখা যায় কবিরা রাজার দরবারে কবিতা ও পুঁথি পাঠ করে শুনাতেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে কবিতার গোড়াপত্তন মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাতে হলেও যারা বিশ্বময় বিকাশে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রেখেছে জমিদারপুত্র শ্রী রবীন্দ্রনাথ থাকুরের হাতে, যদিও এই বিকাশে তারা বাংলা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে তেমন একটা সম্পৃক্ত করতে পারেনাই। কৃষক, শ্রমিক, তাঁতি, জেলে, মুচি, কুলি, বারাঙ্গনা—সমাজের নিচুতলায় বসবাসকারী এই জনগোষ্ঠী নজরুলের মাধ্যমেই বাংলা কবিতায় প্রবেশাধিকার অর্জন করছে। কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে একই কৃতিত্বের দাবিদার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাছাড়া বাংলা সাহিত্যের সূচনালগ্ন থেকেই হিন্দু সাহিত্যিকদের প্রাধান্য ছিল তাতে স্বভাবতই হিন্দু চরিত্রের আধিপত্য থাকার দরুন বাঙালি মুসলমান একাত্ম হতে পারেনি। যেমনটি হয়েছিল বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’ এর ভাবধারার সাথে। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম স্বাতন্ত্র্য চেতনা প্রবল হতে শুরু করে, যা একসময় পাকিস্তান আন্দোলনে পরিণত হয়। নেতৃস্থানীয় মুসলমান ব্যক্তিবর্গের একাংশ স্বতন্ত্র ইসলামি বাংলা সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছে (চল্লিশের দশকে এমনকি রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করার কথাও কারও কারও মুখে উচ্চারিত হয়েছে)। এমন কিছু ঘটলে বাংলা সাহিত্য বিভক্ত হয়ে যেত। এই দুর্ঘটনা থেকে বাংলা সাহিত্যকে রক্ষা করেছেন নজরুল। তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যের মূল স্রোতে অবগাহন করেছে বাঙালি মুসলমান। হিন্দু পুরাণ ও ইসলামি ঐতিহ্য—উভয় উৎস থেকে সমান নৈপুণ্যে উপকরণ সংগ্রহ করে অসাধারণ সৃষ্টিসম্ভার উপহার দিয়েছেন নজরুল। এই যুগল কাব্য স্রোতের রসাস্বাদন করতে বাঙালি মুসলমান দ্বিধা করেনি।
অভাবী পরিবারে বেড়ে ওঠা এ প্রতিভা জীবিকার তাগিদে সম্পৃক্ত হয়েছেন নানা পেশায়। লেটো দলের বাদক, রেল গার্ডের খানসামা, রুটির দোকানের শ্রমিক—নানারকম পেশা বেছে নিয়েছিলেন শৈশব ও কৈশোরে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পথে নেমেছেন। শাসকের কোপানলে পড়েছেন, কারারুদ্ধ হয়েছেন। করেছেন সাংবাদিকতাও। এই সময়গুলোতেই কালি ও কলমে স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়েছেন তিনি।
বাংলা কবিতায় নজরুলের আর্বিভাব একেবারেই উল্কার মতো। বাংলা সাহিত্যে আর্বিভূত হয়ে সমস্ত আকাশকে কীভাবে রাঙিয়ে গেলেন অথবা উজ্জ্বল করে দিলেন তা নিয়ে এখনও গবেষণা হচ্ছে দেশ-বিদেশে।
আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম কে আধুনিক যুগের ভাবধারার সাথে মিলিয়ে বিশ্লেষণ করনে- বেশী কিছু প্রয়োজন হয়না, শুধু তার শিল্পকর্ম ‘ সংকল্প’ ব্যাখা করলেই প্রতীয়মান হয়। কবি সংকল্প কবিতা লিখেন ১৯৩৯ সালের শেষার্ধে। কবির এই কবিতায় সেই সময়ের বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি ও বিজ্ঞানভাবনার একটি অসাধারণ নির্মাণ বুঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন।
কবি জগতের সব রহস্য জানতে চান। সারা বিশ্বের মানুষ যুগ যুগ ধরে কীভাবে নিত্য নতুন আবিষ্কারের নেশায় মৃত্যুভয়কে তুচ্ছজ্ঞান করে এগিয়ে চলছে তা তিনি জানতে চান। বদ্ধঘরে আবদ্ধ না থেকে রহস্যঘেরা অসীম বিশ্ব তথা বিশ্বজগৎকে হাতের মুঠোয় পুরে পরখ করে দেখতে চান। কবি লিখেন, ‘কেমন করে বীর ডুবুরি সিন্ধু সেচে মুক্তা আনে,/ কেমন করে দুঃসাহসী চলছে উড়ে স্বর্গ পানে।/ জাপটে ধরে ঢেউয়ের ঝুঁটি যুদ্ধ-জাহাজ চলছে ছুটি।’
গভীর পানিতে ডুব দিয়ে ডুবুরিরা নানা জিনিস উদ্ধার করে আনে। ‘সংকল্প’ কবিতায় কবি ডুবুরিদের বীর বলেছেন। কারণ তারা নদী বা সমুদ্রের তলদেশ থেকে মুক্তা সংগ্রহ করে। কবি চন্দ্রলোকের অচিনপুরে যেতে চান। চন্দ্রলোক মানে হলো চাঁদের দেশ।
‘সংকল্প’ কবিতায় কবি পাতাল ফেড়ে নামতে চেয়েছেন। পাতাল অর্থ হলো সাগরের তলদেশ বা ভূ-গর্ভের নিচের অংশ। মহাকাশের মতো পাতালপুরীও এক রহস্যময় অজানা জায়গা। অসীম বিশ্বকে জানার অদম্য কৌতূহলী কবি মাটির নিচে পাতালে কী আছে, তা জানার জন্য পাতাল ফেড়ে সেখানে নামতে চান। পাতালের অজানা রহস্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে কৌতূহল মেটাতে চান।
কবি লিখেন, ‘হাউই চড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিনপুরে’। চন্দ্রভিজান, মঙ্গলাভিজান নিয়ে কবির ভাবনায় যেইভাবে প্রকাশিত হয়েছে তা সেই সময়ে বিজ্ঞানীদের ভাবনায় এতটা আসে নাই। সবচেয়ে মজার কথা হচ্ছে কবি যে ‘হাউই’ শব্দটা ব্যবহার করে রকেটের কথা চিত্রিত করেছেন তখন রকেটের ব্যবহার শুরু হয়নাই। কবি অসুস্থ হবার পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথম রকেট ব্যবহার করা হয়।
কবি লিখেন, ‘শুনব আমি ইঙ্গিত কোন মঙ্গল হতে আসছে উড়ে। কবি এইখানে ‘মঙ্গল’ শব্দটি দিয়ে মঙ্গল গ্রহের কথা বলেছেন। ‘ইঙ্গিত’শব্দটা বিশ্লেষণ করলে প্রথমেই মাথায় যেটা আসে তা হল রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি। মহাকাশ অভিযানের এবং মহাকাশের খবর রাখার সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন মাধ্যম। কবি মঙ্গল গ্রহ হতে ভেসে আসা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি শুনতে চান। কারা পাঠাতে পারে সেটা?? মঙ্গলে কি তাহলে প্রানের অস্তিত্বের ধারণা তার মাথায় এসেছিল সেই সময়ে?আজকে আমাদের মঙ্গল নিয়ে কত আলোচনা।বেশ কদিন আগে নাসার রোভার এবং সপ্তাহ দশদিন আগে চাইনিজ মঙ্গলজান মঙ্গল গ্রহে প্রবেশ করে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ভেবে দেখেন আজ থেকে কত বছর আগে একজন স্বশিক্ষিত বাঙালি কবির ভাবনা কতটা আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত ছিল?
কবি লিখেন, “বিশ্ব জগত দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে’। এইটা নিয়ে বেশী কিছু বলার দরকার নাই, যেটি এখন আপনার হাতেই আছে স্মার্টফোন নামক যন্ত্র। বর্তমান যুগ প্রযুক্তির যুগ। এক স্মার্টফোনে বিশ্ব ও আকাশ-পাতালের সবকিছুই সহজলভ্য। এখন কোনকিছুই দূরের নয়। কবি নজরুল সেই কবেই ভেবে রেখেছেন এমন। শিশুতোষ ‘সংকল্প’ কবিতায় তার প্রকাশ ঘটেছে। সত্যিই তাই। এখন স্যাটেলাইট, সাবমেরিন, ওয়াইফাই, মাইক্রোওয়েভ এমন নানা যোগাযোগ প্রযুক্তির কারণে ঘরে বসেই পৃথিবীর ওপ্রান্তের খবর জানা যায়।
কবি লিখেন,
‘কোন বেদনার টিকিট কেটে চন্ডু-খোর এ চীনের জাতি
এমন করে উদয়-বেলায় মরণ-খেলায় ওঠল মাতি।‘
আয়ার্ল্যান্ড আজ কেমন করে স্বাধীন হতে চলছে ওরে
তুরস্ক ভাই কেমন করে কাটল শিকল রাতারাতি!
কেমন করে মাঝ গগনে নিবল গ্রিসের সূর্য-বাতি।’
১৯৩৯ সালে মাও সেতুং তখন সমাজতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বিল্পব করে চলেছে, বিল্পবের রক্তের হেলিখেলায় পুরো চীন বিধ্বস্ত। সেই সময়ের চীন কে কবি বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। আয়ারল্যান্ড যুক্তরাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রথমে আইরিশ ফ্রি স্টেট এবং পরবর্তিতে প্রজাতন্ত্রী আয়ারল্যান্ড প্রতিষ্ঠা করছে, তুরস্ক খিলাফত থেকে বের হয়ে প্রজাতন্ত্রের দিকে পা বাড়িয়েছে, গ্রীক সভ্যতার সমাপ্তির দামামা বাজতে শুরু করেছে বিশ্বজুড়ে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের মেলবন্ধন ঘটিয়ে নজরুল একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় নবসৃষ্ট রাষ্ট্র পাকিস্তানে ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে, যার পরিণতিতে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
তিনি বিদ্রোহী কবি ৷ তিনি টর্পেডো ৷ তিনি মহাপ্রলয়ের নটরাজ ৷ এই অভিধাগুলোর আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছে তাঁর বহুমুখী প্রতিভার অনেক দিক ৷ জীবনের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেওয়া ব্যক্তিগত শোক যেমন অনুচ্চরিত থাকে দুখু মিঞার জীবনচর্চায়, ঠিক তেমনই অনালোচিত থেকে যায় সিনেমার পর্দায় কাজী নজরুল ইসলামের কাজ ৷
সংখ্যায় মাত্র একটি হলেও নজরুল বাংলা ছবি পরিচালনা করেছিলেন ৷ সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি তাঁকে দেখা গিয়েছিল অভিনয়ও ৷ তিনের দশকে ফিল্ম কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল নজরুলের ৷ প্রতি মাসে তাঁর পারিশ্রমিক ছিল ৫০০ টাকা ৷ ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি মুক্তি পেয়েছিল নজরুল পরিচালিত একমাত্র ছবি ‘ধ্রুব’ ৷ নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষের লেখা ‘ভক্ত ধ্রুব’ অনুসারে তৈরি এই ছবিতে সহ-পরিচালক ছিলেন নজরুল ৷ আর একজন পরিচালক ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দে৷
নজরুলের সঙ্গীত পরিচালনায় সেকালে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল ‘ধ্রুব’-র গানগুলি ৷ ছবিতে ব্যবহৃত ১৮ টি গানের মধ্যে ১৭ টিরই সুর দিয়েছিলেন তিনি ৷ চারটে গানে প্লেব্যাকও করেছিলেন ৷ পাশাপাশি, ফিল্ম কোম্পানির কথায় ছবিতে নারদের ভূমিকায় অভিনয়ও করেছিলেন অগ্নিবীণার স্রষ্টা ৷ বাকি কুশীলবদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী, আঙুরবালা, পারুলবালা, নিত্যানন্দ ঘটক, কুঞ্জলাল চক্রবর্তী, কার্তিক দে এবং যুগ্ম পরিচালক সত্যেন্দ্রনাথ দে ৷ তবে এই ছবির পর সেই ফিল্ম কোম্পানির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন নজরুল ৷ শোনা যায়, পারিশ্রমি নিয়ে দু পক্ষের মতান্তরই এর কারণ ৷
বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তার কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তার কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই ১৯৭২ সালের ২৪ মে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবিকে সপরিবারে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তার বসবাসের ব্যবস্থা করেন।
Leave a Reply