মাতৃভাষার জুম্মা’র খুৎবা কেন দরকার
জুম্মার খুৎবা টা সকল খতীবের মাতৃভাষায় পড়া উচিত। ৯৫% মুসল্লী আরবি ভাষা বুঝেনা। মসজিদে গিয়ে খুৎবার অর্থ না বুঝে সিংহভাগ মুসল্লী নামাজ আদায় করেন। আরব ব্যাতিত মুসলিম বিশ্বে খুৎবা মাতৃভাষায় প্রদান করে, শুধু তা নয় ইন্দোনেশিয়া, মালেয়শিয়া সহ অনেক দেশে দেখেছি দেশ ব্যাপী একই ধরনের খুৎবা পাঠ করা হয়। আরবি মাসের শুরুতে টপিকস নির্ধারণ করা হয় সারা বছর কি কি বিষয়ে খুৎবা প্রদান করা হবে। লকডাউনের আগে মালেয়শিয়ার মসজিদ নেগারতে জুমার নামাজের টপিকস ছিল ইসলাম ও স্যাটেলাইট নিয়ে। বাংলাদেশের সেনানিবাসের মসজিদ গুলো সাধারণ মসজিদ গুলোর চেয়ে এগিয়ে আছে। ক্যান্টনমেন্টের অনেক মসজিদে এখন প্রোজেক্টর রাখা হয় আর সেখানে আযানের সময় আযানের বাংলা অর্থ, আরবিতে খুৎবার সময় সেটার বাংলা অর্থ আর বাংলায় খুৎবার সময় আয়াতগুলো দেখানো হয়। মনোযোগ তো অনেকটা বাড়েই আর সাথে অর্থ বুঝতে পারাটা হলো সব থেকে বড় পাওনা।
খুতবা আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো ভাষণ: বক্তৃতা, প্রস্তাবনা, ঘোষণা, সম্বোধন, উপস্থাপনা ইত্যাদি। খুতবা হলো জুমার নামাজের আগে, উভয় ঈদের নামাজের পরে, হজে আরাফার দিনে মসজিদে নামিরাতে, বিয়ের অনুষ্ঠানে ও বিভিন্ন ইসলামি অনুষ্ঠানে খলিফার প্রতিনিধি, দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা ইমাম ও খতিব কর্তৃক প্রদত্ত প্রাসঙ্গিক বক্তৃতা বা ভাষণ।
মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর কুবার মসজিদে প্রথম জুমার নামাজ আদায় করেন। এতে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেই ইমামতি করেন। এদিন জুমার নামাজের আগে তিনি দুটি খুতবা প্রদান করেন। তখন থেকেই শুক্রবারে জুমার নামাজের জামাতের আগে দুটি খুতবা প্রদানের প্রথা প্রচলিত।
নবী করিম (সা.) এর সময় ইসলাম আরব উপদ্বীপেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাদের মাতৃভাষা ছিল আরবি। খুলাফায়ে রাশেদিনের আমলে ইসলাম বিস্তৃতি লাভ করে। ফলে এসব অঞ্চলে আরবি ভাষা দ্রুত বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসেবে পরিণত হয়েছিল। তাই স্বভাবতই জুমার নামাজের খুতবা আরবিতে প্রদান করা হতো।
খুতবা জুমার নামাজের শর্ত বা ফরজ। খুতবা ব্যতীত জুমার নামাজ হয় না। উপস্থিত মুসল্লিদের জন্য খুতবা শ্রবণ করা ওয়াজিব। তাই খুতবা চলাকালে নিরর্থক কাজে মশগুল থাকা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জুমার দিন খুতবা প্রদানের সময় যদি তুমি তোমার সঙ্গীকে বলো, ‘চুপ করো’ তখন তুমি অনর্থক কথাই বললে। -সহিহ বোখারি: ১/১২৮
বর্ণিত হাদিস দ্বারা সুদৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয়, খুতবার সময় নিশ্চুপ হয়ে খুতবা শ্রবণ করা ওয়াজিব এবং কথাবার্তা বলা হারাম। অনুরূপ খুতবার সময় সুন্নত-নফল নামাজ পড়াও বৈধ নয়। অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যখন ইমাম খুতবার জন্য বের হবেন, তখন নামাজ পড়বে না, কথাও বলবে না। -মেশকাত: ৩/৪৩২
তাই মুসল্লিদের উচিত খুতবার সময় কথাবার্তা থেকে বিরত থেকে অত্যন্ত মনোযোগী হয়ে খুতবা শ্রবণ করা এবং যেসব কাজ নামাজে নিষিদ্ধ তা থেকে বিরত থাকা। ফিকাহ শাস্ত্রের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ‘ফাতাওয়ায়ে শামী’তে একটি মূলনীতি উল্লেখ হয়েছে, যেসব কর্ম নামাজের মধ্যে হারাম, তা খুতবা চলাকালীন সময়ও হারাম। যেমন- কথাবার্তা বলা, পানাহার করা ইত্যাদি। -ফাতাওয়ায়ে শামি: ৩/৩৫
বর্তমানে অনেক মসজিদে লক্ষ করা যায়, খুতবা চলাকালে অনেক মুসল্লি নামাজবিরোধী কর্মে লিপ্ত হয়, যা সম্পূর্ণ শরিয়ত পরিপন্থী এবং হারাম। এছাড়া অনেক মসজিদে খুতবা চলাকালে চাঁদার বাক্স চালানো হয়, এটা শরিয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নাজায়েজ। খুতবার সময় এসব নাজায়েজ কর্ম পরিহার করে মনোযোগী হয়ে খুতবা শ্রবণ করা অত্যন্ত জরুরি।
খুতবার কিছু সুন্নত রয়েছে, খতিবদের সেসব সুন্নত অনুসরণ-অনুকরণ করা প্রয়োজন। ফিকাহ শাস্ত্রের অন্যতম গ্রন্থ ‘ফাতাওয়ায়ে আলমগীরি’তে খুতবার ১৫টি সুন্নত উল্লেখ করা হয়েছে। তা হলো-
এক. পবিত্রতার সঙ্গে খুতবা প্রদান করা। অজু ছাড়া বা নাপাক অবস্থায় খুতবা দেয়া মাকরুহ।
দুই. দাঁড়িয়ে খুতবা দেয়া। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, হজরত জাবের ইবনে সামুরা (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) দাঁড়িয়ে খুতবা প্রদান করতেন। -মুসলিম শরিফ: ১/২৮৩
তিন. মুসল্লিদের দিকে মুখ করে খুতবা পাঠ করা। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মিম্বরে দাঁড়াতেন, তখন আমরা তার সম্মুখ হয়ে বসতাম। -সুনানে তিরমিজি: ১/১১৪
চার. খুতবার আগে অন্তরে ‘আউজুবিল্লাহ’ পাঠ করা।
পাঁচ. মুসল্লিদের খুতবা শ্রবণ করানো। অর্থাৎ খুতবা উচ্চৈঃস্বরে পাঠ করা, যাতে করে মুসল্লিরা খুতবা শ্রবণ করতে পারেন।
ছয়. আল্লাহর প্রশংসার মাধ্যমে খুতবা শুরু করা।
সাত. খুতবায় আল্লাহপাকের এমন প্রশংসা করা, যার উপযুক্ত একমাত্র তিনিই।
আট. কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করা।
নয়. হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) ওপর দরুদ পাঠ করা।
দশ. ওয়াজ-নসিহত করা।
এগারো. ছোট তিন আয়াত বা বড় এক আয়াত পরিমাণ কোরআন তেলাওয়াত করা।
বারো. দ্বিতীয় খুতবায় আল্লাহপাকের প্রশংসা এবং নবী করিম (সা.) এর ওপর দরুদ পাঠ করা।
তেরো. সমগ্র পৃথিবীর মুসলিম নরনারীর জন্য দোয়া করা।
চৌদ্দ. খুতবা সংক্ষিপ্ত হওয়া। নামাজে পঠিতব্য তিওয়ালে মুফাসসল তথা দীর্ঘ সূরা রয়েছে, খুতবা সেগুলোর মধ্য থেকে যে কোনো একটির সমপরিমাণ হওয়া। হাদিস শরিফে খুতবা সংক্ষিপ্ত করার প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে। হজরত আম্মার (রা.) বলেন, আমি হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, কোনো ব্যক্তির নামাজের দীর্ঘতা এবং খুতবার সংক্ষিপ্ততা তার সূক্ষ্ম জ্ঞানের পরিচায়ক। সুতরাং তোমরা নামাজকে দীর্ঘ করবে এবং খুতবাকে সংক্ষেপ করবে। -সহিহ মুসলিম শরিফ: ১/২৮৬
পনেরো. দুই খুতবার মাঝে ছোট তিন আয়াত পড়া যায়, এ পরিমাণ সময় বসা। -ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি: ১/১৪৬
আল্লামা কাসানি (রহ.) উল্লেখ করেন, জুমার খুতবা দুইটি হওয়া সুন্নত এবং খুতবা মিম্বরে দেয়া সুন্নত। কেননা, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে খুতবা প্রদান করতেন। হজরত জাবের ইবনে সামুরা (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) দুইটি খুতবা পাঠ করতেন এবং উভয় খুতবার মাঝখানে বসতেন। তিনি কোরআন তেলাওয়াত করতেন এবং লোকদের উপদেশ দিতেন। ‘ –সহিহ মুসলিম শরিফ: ১/২৮৩
মহানবী (সা.)-এর মাতৃভাষা ছিল আরবি, তাঁর শ্রোতাদের ভাষাও ছিল আরবি। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে ‘নবী করিম (সা.) জুমার নামাজের আগে দুটো খুতবা দিতেন। একটা শেষ করে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য বসতেন, তারপর দ্বিতীয় অংশটি দিতেন। খুতবার মাঝে তিনি পবিত্র কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত করে মানুষকে উপদেশ দিয়ে বোঝাতেন। (মুসলিম, কিতাবুল জুমা)। ঈদের খুতবায় তিনি সমসাময়িক বিষয়াদিতে করণীয় দায়িত্ব সম্বন্ধে সবাইকে সজাগ করতেন। আর্থিক কোরবানি করতে অনুপ্রাণিত করতেন। মুসলমানদের অনুসৃত প্রধান ধর্মগ্রন্থের ভাষা আরবি, যে ভাষায় পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। তাই ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম নামাজসহ অত্যাবশ্যকীয় ইবাদত-বন্দেগিতে মুসলমানেরা আরবি ভাষা ব্যবহার করে থাকেন।
জুমার নামাজের আগে খুতবা পাঠ নামাজেরই বিশেষ অংশ। তাই এ ব্যাপারে পূর্ববর্তী আলেম-উলামাদের ইজমা বা ঐকমত্য হয়েছেন যে মূল খুতবা আরবিতেই পাঠ করতে হবে। তবে খুতবা পাঠের আগে প্রত্যেক মুসলিম উম্মাহ নিজ নিজ দেশে মাতৃভাষায় মূল বক্তব্যটুকু বলে দিলে সবাই খুতবার সারমর্মের প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগী হতে পারবে। খতিব সাহেব জুমার খুতবা দুটির প্রতিটি আরবি ভাষায় পেশ করার পর মিম্বরে দণ্ডায়মান অবস্থায় স্থানীয় মাতৃভাষায় এর অনুবাদ পেশ করতে পারেন। আরবি ভাষার বিপরীতে সাধারণ জনগণের মাতৃভাষায় জুমার খুতবা প্রদানের বৈধতায় বর্তমান যুগের আলেমদের মতৈক্য রয়েছে।
মাতৃভাষায় জুমার খুতবার আগে সমাজে প্রচলিত অন্যায়-অবিচার, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, মাদকাসক্তি, মজুতদারি, কালোবাজারি, মুনাফাখোরি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, বোমাবাজি, হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি সামাজিক অনাচার ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং দুর্লঙ্ঘ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অথবা গরিব-মিসকিন, অনাথ আত্মীয়স্বজন, অভাবগ্রস্ত পাড়া-প্রতিবেশী, অভুক্ত অনাহারী ও আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসতে সামর্থ্যবানদের সহযোগিতার দিকনির্দেশনা প্রদান করা দরকার।
সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে, পরিবার পরিকল্পনায়, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ও অর্থনৈতিক যাবতীয় বৈষম্য বা বেকারত্ব দূরীকরণে আত্মকর্মসংস্থানের বাস্তব কোনো রূপরেখা, কর্মপদ্ধতি, সতর্কবাণী বা কোনো আভাস-ইঙ্গিত জুমার খুতবার আগে সাধারণ আলোচনায় স্থান দিতে হবে। সমাজে বিশ্বমানবতার ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সাম্য, মৈত্রী, আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি ও সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠামূলক উদারনৈতিক উপদেশ ইমাম-খতিবদের সাপ্তাহিক বক্তব্যে বা ভাষণে থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়।
ইসলামের আরাবিয়ান ব্যাখ্যা শুধু আরবদের ক্ষেত্রে অন্যান্য অঞ্চলের জন্য নয়। আল্লাহ সুবাহানু তায়লা সব ভাষার সৃষ্টিকর্তা । যেহেতু খুতবা শোনা ইবাদত এবং জুমার অপরিহার্য অংশ। তাই মুসল্লিদের এ সম্পর্কে জানতে হবে। যদি নাই বুঝি তাহলে কিভাবে ওয়াজিব পালন করব। ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একটা অনুশাসন করা উচিত খুৎবা যাতে মাতৃভাষায় দেয়ার জন্য খতিবদের কে নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
Leave a Reply