বর্তমান বাস্তবতায় ‘আবাসিক’ এলাকার চরিত্র কী?

বর্তমান বাস্তবতায় ‘আবাসিক’ এলাকার চরিত্র কী?

আবাসিক এলাকা হল এমন জমি যেখানে শিল্প ও বাণিজ্যিক অঞ্চলের পরিবর্তে আবাসন অধিকতর প্রাধান্য পায়। বিভিন্ন আবাসিক এলাকাসমূহের মধ্যে আবাসন ব্যবস্থাও উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। বিভিন্ন প্রকার আবাসন ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে একক-পরিবার আবাসন, বহু-পরিবার আবাসিক, বা পরিবহনযোগ্য বাড়ি ।

মানুষেরই কেবল ‘চরিত্র’ থাকে, মানুষই কেবল ‘চরিত্রবান’ হয়, আমাদের প্রচলিত শিক্ষা থেকে এমনটিই জেনে এসেছি। এতোদিন পর সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘আবাসিক এলাকাকে আবাসিকচরিত্র’এ ফিরিয়ে আনার।

তো সেই আবাসিক এলাকার চরিত্র কেমন? ঢাকা শহর তো আজকের শহর নয়। বুড়িগঙ্গা নদীকে সাক্ষী মেনে ৪০০ বছরেরও আগে গড়ে উঠেছিল এই শহর। তখন শহরের গন্ডি ছিল ছোট। গ্রান্ড এরিয়া বা আজকের গেন্ডারিয়া ঢাকার আবাসিক চরিত্র পেয়েছিল প্রথম।

পরিকল্পিত নগরের জন্য পাকিস্তান আমলে গড়ে উঠেছিল ডিআইটি যার রূপান্তিত নাম রাজউক(রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ)। তাদের  পরিকল্পনার প্রথম ‘শহর’ ধানমন্ডি। সেই থেকে গুলশান, বারিধারা, উত্তরা, নিকুঞ্জ আর হালে গড়ে ওঠা পূর্বাচল আবাসিক এলাকার সম্প্রসারিত উদাহরণ।

আবাসিক এলাকা কাকে বলে, তার একটা নিয়ম-রীতি নিশ্চয় আছে রাজউকের কাছে। আবাসিক প্লট  পেতে  সেই নীতিমালার শর্ত মানা হয় অক্ষরে অক্ষরে।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক ভবন সরিয়ে নেওয়ার একটি প্রক্রিয়া চলছে। অননুমোদিত স্থাপনা ও আবাসিক এলাকার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ স্থাপনাগুলো সরিয়ে আবাসিক এলাকার সুষ্ঠু সামাজিক পরিবেশ ফিরে আসুক, এটা সবারই চাওয়া। তবে সেটা করা উচিত নগর–পরিকল্পনার আধুনিক ধারণা ও আবাসিক এলাকাগুলোর বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে।

আধুনিক নগর-পরিকল্পনায় আবাসিক এলাকা শুধু আবাসনের ব্যবস্থা নয়, বরং একটি ‘টেকসই সামাজিক’ পরিবেশ। বাসিন্দাদের চাহিদা অনুযায়ী সামাজিক সুযোগ-সুবিধা, গণপরিসর, প্রাত্যহিক কেনাকাটা, প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বাজার ইত্যাদি সুবিধা থাকে। আমাদের পরিকল্পিত আবাসিক এলাকাগুলো নিয়ে কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রথমত, আবাসিক এলাকাগুলো যে–সংখ্যক বাসিন্দার বিবেচনায় তৈরি করা হয়েছিল, সেই অনুপাতে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছিল কি? অথবা, বর্তমানে যত মানুষ বাস করে, তাদের চাহিদা অনুযায়ী সামাজিক সুযোগ-সুবিধা আছে কি?

ধরা যাক ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার কথা। কেমন ছিল এর পরিকল্পনা? ১৯৫০ সালে পূর্ত বিভাগ ৫০০ একর জমির ওপর উচ্চবিত্তদের আবাসনের জন্য ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় ১ হাজার ৮৫টি প্লট তৈরি করে। মূলত সরকারি আমলা, মন্ত্রী, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা ও বিভিন্ন পেশাজীবীকে এসব প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। শুরুতে এক বিঘার একেকটি প্লটের সামনে বাগানসহ দোতলা বাড়ির কথা বিবেচনা করে এই আবাসিক এলাকা ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষের জন্য পরিকল্পনা করা হয়। সেখানে ৬১ শতাংশ ভূমি আবাসিক প্লট, ৯ দশমিক ২ শতাংশ লেক, ৯ দশমিক ২ শতাংশ উন্মুক্ত স্থান, ১৮ শতাংশ রাস্তা, ৪ দশমিক ৭ শতাংশ মসজিদ এবং ৪ দশমিক ২ শতাংশ স্কুলের ব্যবস্থা রেখে পরিকল্পনা করা হয়। সে সময় অন্যান্য সামাজিক সুযোগ-সুবিধা অথবা প্রাত্যহিক জীবনের চাহিদা অনুয়ায়ী কেনাকাটা, সামাজিক কর্মকাণ্ড এখানে বিবেচনায় আনা হয়নি। বিশুদ্ধ আবাসিক এলাকার এই ধারণা বর্তমানে অচল, একে নিরুৎসাহিত করা হয়। কারণ, এতে সোশ্যাল সেগ্রিগেশন বাড়ে, বৈষম্য তৈরি হয়, শহরের রাস্তার ওপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়।

আবাসিক এলাকায় অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিতভাবে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের কারণে কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) গবেষণা জার্নালে এ বিষয়ে, বিশেষত ধানমন্ডির বিষয়ে গবেষণালব্ধ যেসব ফলাফল এসেছিল, তার মধ্যে নিচের বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমত, দফায়-দফায় সরকারি সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার প্লট বিভক্ত হয়েছে। বেশির ভাগ এক বিঘার প্লট ভাগ হয়ে পাঁচ কাঠার প্লটে পরিণত হয়েছে, ইমারতের উচ্চতা দুই তলা থেকে ছয় তলায় রূপান্তরিত হয়েছে। এতে এলাকায় পরিবারের সংখ্যা ও মোট জনসংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু গণপরিসর ও নাগরিক সুবিধা আনুপাতিক হারে বাড়েনি বরং অনেক ক্ষেত্রে কমেছে। আজ ধানমন্ডির দেড় লাখ মানুষের জন্য আইনত সেই পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা আছে, যা ২০ হাজার মানুষের জন্য ছিল।

দ্বিতীয়ত, কোনো গবেষণা ছাড়া এলাকার সত্যিকার চাহিদা নিরূপণ না করে সাতমসজিদ রোড, মিরপুর রোড, ২৭ নম্বর রোড ও ২ নম্বর রোডের প্লট কোনো ধরনের ‘নীতিমালা’ ছাড়াই বাণিজ্যিক প্লট হিসেবে ঘোষণা করার ফলে এমন ধরনের ভূমি বা ভবন ব্যবহার করা হয়েছে, যা আবাসিক এলাকার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ভূমি বা ভবন ব্যবহারের ধরন এমন যে শহরের অন্যান্য এলাকা থেকেও মানুষ ও গাড়ি আসতে উৎসাহিত করে। এই রাস্তাগুলো ধারণক্ষমতার তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি গাড়ি বহন করে। প্রধান সড়কে দেখা যায় ৫৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ গাড়ি এলাকার বাইরে থেকে আসে।

তৃতীয়ত, একটা গবেষণা থেকে দেখা যায়, ৪০ দশমিক ৬৮ শতাংশ প্লটে পার্কিং থাকলেও তা অনুমোদিত পার্কিংয়ের তুলনায় কম, পার্কিংয়ের স্থান বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হয়। শুধু ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ প্লটে বেসমেন্ট পার্কিং আছে আর ৪৬ দশমিক ৬১ শতাংশ প্লটের আইনসম্মত পার্কিং ছিল না।

নগর-পরিকল্পনার সূচক ও ড্যাপের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১২ হাজার ৫০০ মানুষের জন্য কমপক্ষে দুই বা সর্বোচ্চ তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রয়োজন হবে। সুতরাং ধানমন্ডি এলাকায় ২০০৮ সালের হিসাব অনুযায়ী দেড় লাখ মানুষের জন্য শুধু স্থানীয় প্রয়োজন মেটাতে ২৪ থেকে ৩৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় দরকার।

বিশুদ্ধ আবাসিক এলাকা উন্নয়নের ধারণাটি এখন সেকেলে হিসেবে বিবেচিত। এখন একে নিরুৎসাহিত করা হয়; অন্ততপক্ষে ৩০ শতাংশ প্লটের অনাবাসিক-মিশ্র ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হয়। তবে সেসব ব্যবহার অবশ্যই আবাসিক ব্যবহারের সঙ্গে পরিপূরক হতে হবে। আধুনিক নগর-পরিকল্পনার স্মার্ট সিটি, টি ও ডি ইত্যাদি ধারণাও মিশ্র ভূমি ব্যবহারের কথা বলে। কিন্তু কারণ কী? গাড়িশিল্প বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে উন্নত বিশ্বে একসময় ব্যক্তিগত গাড়িনির্ভর শহর তৈরি করা হতো। ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ‘একক-কার্যভিত্তিক (mono-functional)’ এলাকা গড়ে তোলার মাধ্যমে নগর-পরিকল্পনা করা হতো। ফলে আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদন, কেনাকাটার জন্য মার্কেট, বাজার, শিল্প, প্রাতিষ্ঠানিক ইত্যাদি প্রতিটি এলাকা আলাদা করে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন করা হতো। ফলে মানুষের আবাসিক এলাকা তার কর্মক্ষেত্র, সামাজিক ও দৈনন্দিন ব্যবহার্য কাজের জায়গা থেকে আলাদা হয়ে যায়। প্রতিদিনের কাজ সম্পাদনের জন্য মানুষ সড়ক ও গাড়িনির্ভর হয়ে পড়ে।

এক সময় ধানমন্ডি আর গুলশানের সবগুলো বাড়ি ছিলো ডিআইটি- রাজউকের নিয়ম মেনে করা। সামনে বাগান বা খালি জায়গা। আবাসিক এলাকার ভেতর বা বাড়ির মধ্যে কোনও দোকান পাট করতো না কেউ।এক সময় গুলশান ছিল ‘কূটনৈতিক এলাকা’। সেখানে লেখা থাকতো ‘লাইলেন্স জোন’ বা নীরব এলাকা। সেসব এখন দূর অতীত। এখন ধানমন্ডি, গুলশান, বারিধারা, উত্তরা দেখে বোঝার উপায় নেই সেগুলো আবাসিক না বাণিজ্যিক এলাকা। একতলা, দোতলা, তিনতলা বাড়ি ভেঙে করা হচ্ছে বহু-বহুতল ভবন।

বর্তমান বাস্তবতা ও আধুনিক নগর-পরিকল্পনার ধারণা বিবেচনায় নিয়ে আবাসিক এলাকাগুলোর ভূমি ও ভবন ব্যবহারের জন্য পেশাজীবীদের পরামর্শে নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। বর্তমানে উন্নত বিশ্বের শহরগুলো মিশ্র ভূমি ব্যবহারকে প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পনা করে থাকে। গণপরিবহন, পথচারীবান্ধব নিরাপদ ফুটপাত, সামাজিকভাবে দেখা হওয়ার মতো স্থানসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করার মতো পরিকল্পনা করে। কোনো কোনো শহরে আইন করে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অনাবাসিক ভূমি ব্যবহারের কথা বলে দেওয়া হয়। সেই পরিমাণটি ওই শহরের স্থানীয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। শুধু প্রশাসনিক আদেশ দিয়ে সমস্যার সমাধান করা যাবে না বরং বাড়বে। তাই বর্তমান বাস্তবতায় যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে তা হলো—

১. আবাসিক এলাকার সঙ্গে পরিপূরক নয় এমন সব অননুমোদিত ভূমি ও ভবন ব্যবহার বন্ধ করা।

২. এলাকায় বর্তমানে বসবাসরত মানুষের চাহিদা অনুসারে এবং আবাসিক এলাকার সঙ্গে পরিপূরক এমন প্রাত্যহিক প্রয়োজনীয় কাজ ও সামাজিক কাজের সুযোগ রেখে নীতিমালা প্রণয়ন করা এবং এই কাজে নগর–পরিকল্পনাবিদ, স্থপতিসহ অন্যান্য পেশাজীবীর সাহায্য নেওয়া। মাঠপর্যায়ে প্লট-টু-প্লট জরিপ করার মাধ্যমে এবং ড্যাপের প্রস্তাবিত সূচকের আলোকে এই নীতিমালা প্রণীত হবে।

৩. প্রস্তাবিত নীতিমালার আলোকে প্রয়োজনীয় সামাজিক সুযোগ-সুবিধার সংস্থান করতে হবে। বর্তমানে অনুমোদনহীন অথচ নীতিমালা অনুসারে আবাসিক এলাকার জন্য প্রয়োজন এমন স্থাপনাকে প্রচলিত নিয়ম অনুসারে অতিরিক্ত ফি প্রদানের মাধ্যমে অনুমোদন করা যেতে পারে।

৪. সেবা প্রদানের স্থানগুলো যেমন স্বাস্থ্যসেবা, উপদেষ্টা ফার্ম ইত্যাদি আবাসিক এলাকায় প্রয়োজন আছে তবে সে ক্ষেত্রে তার জনবল, সেবা গ্রহণকারী সংখ্যা ও প্রতিষ্ঠানের স্পেস নির্দিষ্ট করে দেওয়া। তবে সেবা গ্রহণের জন্য অন্য এলাকা থেকেও মানুষ আসবে এমন ধরনের বড় স্থাপনা তৈরির জন্য ভূমি ব্যবহার অনুমোদন না দেওয়া।

৫. প্লটের অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী বেসমেন্ট বা ভূতলের গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা সুনিশ্চিত করা, তার স্থলে অন্য কোনো কাজে ব্যবহৃত হলে সেগুলোর ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া।

৬. বর্তমান ‘মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮’-এর মান নিয়ে নতুন করে গবেষণা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বর্তমান বিদ্যমান উচ্চ FAR মানের কারণে আবাসিক এলাকার জনসংখ্যার সার্বিক জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি হয়ে যায়, যা সব ধরনের সামাজিক ও নাগরিক সেবার ওপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে।

শেষ কথা হচ্ছে, আবাসিক এলাকার সঙ্গে পরিপূরক নয় এমন ভূমি বা ভবন ব্যবহার যেমন বন্ধ করতে হবে, তেমনি আবাসিক এলাকাগুলোকে সামাজিকভাবে টেকসই করার জন্য সে এলাকার জনগণের চাহিদা বিচার-বিশ্লেষণ করে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। এটাই পথ।

 

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *